শীতের সকাল

শীতের সকাল। সচরাচর অন্য অনেক শীতের সকাল থেকে ভিন্ন। শুভ্র সকালের মসলিন আচ্ছাদন, পেজো তুলোর মতো গাছের ডালে লেপ্টে থাকা তুষারের মুগ্ধতা শিহরিত করে, ক্ষণিকের জন্য ভুলিয়ে দেয় হাঁড় কাঁপানো ‘শীতের চোদন‘!

বৃক্ষ জীবন; মানবের বৃক্ষ

বলছি না যে সকালটা অন্য আর সকালগুলোর মতই ছিল। উয়িন্ডি, রেইনি এন্ড কোল্ড। স্বভাবত এভাবেই বর্ণনাটা যুতসই। গাড়ি পার্ক করে কর্মস্থানে প্রবেশ করার আগে কিছুটা হাটা পথ। অন্য দিনগুলোর মতই হাঁটছিলাম। মাথায় তুলে নেওয়া হুডি বাতাসের ঝাপটায় মাথা থেকে সরে যাচ্ছিল। অনেক খানি সামনের দিকে টেনে নিতে গিয়েই চোখে পড়ল এই দৃশ্য। থমকে দাঁড়ালাম। কি একটা তীক্ষ্ণ উপলব্ধি বিদ্যুৎ গতিতে মাথায় খেলে গেল। তার পর সেই উপলব্ধির একের পর এক ব্যবচ্ছেদ। নিজের মনে প্রশ্ন, নিজের মনেই উত্তর আসে। কিন্তু যে উপলব্ধির তীক্ষ্ণতা বোধ আর উপলব্ধির মাত্রাকে পাশ খাটিয়ে অন্য এক মাত্রায় দুলতে থাকে, তাকে কি এই কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সময় বাধ্যবাধকতার মইয়ে ছোঁওয়া যায়? তাই ভিডিও করে নিলাম। তার পর অনেকদিন গেছে। বেশ কয়েকবার দেখেছি। যেই সময়ে আমি ভিডিওটি রেকর্ড করি, সেই সময়ের অনুভূতি ফিরে আসছিল না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নতুন ইংরেজি বর্ষ ২০১৭। অর্থাৎ ২০১৬ এর বিদায়। মানে ঝড়ে যাওয়া আরেকটি বছর।

এই বাতাসের সাথে উড়ে যাওয়া পাতা, এই যে ক্ষণ, অনেক ভাবেই আমি একে উচ্চারণ করেছি। ঝড়ে যাওয়া, খসে পরা, ছিটকে পরা, মরে যাওয়া, পরে যাওয়া। কি থেকে বা কার থেকে অথবা কোথায় থেকে প্রশ্নের উত্তর অবশ্য একটাই, বৃক্ষ থেকে। যদিও বৃক্ষ কে ছোট, বড় কিংবা বট গাছ ইত্যাকার বিশেষণ জুড়ে দেওয়া যায় কিন্তু উৎসমুখ তো একটাই, বৃক্ষ।

 

শুনেই তো আসছি, মানব জীবন আর বৃক্ষ জীবন বেশ কিংবা অনেকটাই সাদৃশ্যপূর্ণ।

 

এই  গাছের পাতার মতই মানব জীবন ঝরে যায়। সময় হলে। ছোটকালে বাবার কাছে একটি গল্প না ঠিক, মিথ, প্রায় শুনতাম। যখন স্বচ্ছ চাঁদ আকাশে দেখা দিত। বাবা চাঁদের দেশের বিরাট গাছ কে দেখিয়ে বলতেন যখন ঐ চাঁদের গাছে নতুন পাতা জন্ম নেয় তখন সেই পাতায় যার নাম লেখা থাকে দুনিয়াতে তার জন্ম হয়। আর যখন ঐ চাঁদের গাছের একটি পাতা ঝরে পরে তখন দুনিয়াতে সেই পাতায় লেখা যার নাম তার মৃত্যু হয়।

 

এই গাছের পাতার মতই আমরা ঝরে পড়ছি, খসে পড়ছি, ছিটকে পরছি, পতিত হচ্ছি। উড়ে যাচ্ছি। কিন্তু কার থেকে, কি থেকে সেটা বেশ একটু জটিলই। বৃক্ষ জীবন আর মানব জীবন সম ভেবে সহজেই বলতে পারতাম, পাতা যেমন গাছ থেকে আমরা তেমনি জীবন থেকে। কিন্তু সেই বলা কি সঠিক হত?

 

আমাদের তো জীবনকালে ছিটকে, খসে, পতিত হওয়ার আগেই অনেকবার ছিটকে,খসে, পতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। পরিবার থেকে, সমাজ থেকে, ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে। স্বপ্নের কাছ থেকে, কাঙ্ক্ষিত বাসনা, কামনা আর আপন বলয় থেকে। পাতার মত উরে উরে কোথায় যে যাই, কারো উঠোনে, দরজার সামনে কিংবা চালে। পিচ ঢালা রাস্তায় নয়ত গ্রামের কোন মেঠো পথে। নিজের বৃক্ষ জীবনের কাছে কি যাই কখনো ফিরে? না।

তাই, আমার কাছে, জীবন থেকে খসে পরা, ছিটকে পরা শুরু জীবন শুরুর সাথে সাথেই। মায়ের কোল থেকেই যার শুরু।

কিন্তু বার বার একই প্রশ্ন, তাহলে আমার বৃক্ষ কে?

 

 

 

 

 

ক্ষুদ্রের অসীমতা…..

জীবন কখনো ব্যর্থ হয়না, বরং আমাদের ইচ্ছা, আখাংকা, ব্যর্থ হয়। জীবনের সারিবদ্ধ সোপান ক্রমিকমান অনুযায়ী মাড়ানো হয়নি বলে যে জীবন ব্যার্থ, এই ধারনা আরোপিত, স্বতঃসিদ্ধ নয়।জীবনের রেডিমেড পোষাকে নিজেকে দেখতে আমাদের দুর্বলতা, নমনীয়তা আমাদের ‘সাধারন’ হয়ার প্রবনতা এনে দেয়। ‘আমি অতি সাধারন’ বোধের আত্বপ্রবঞ্চনা আমাদের কাছে মানবীয় উচ্চতার মান নিয়ন্ত্রক। 

জীবনের ‘স্টেজ’ গুলো কৃত্রিম, এখানে সংযোজন, বিয়োজন প্রতিনিয়ত আবর্তিত হয় সময়ের চক্রিক সিড়ি বেয়ে। হতে পারে দ্বিমাত্রিক-ত্রিমাত্রিক। কিন্তু ছোখ আটকে যাওয়া কিংবা আপাত অপেক্ষাকৃত বেশি সুবিধাজনক মনে হওয়া সিড়িতেই আমাদের জীবনের লক্ষ্য নিক্ষিপ্ত হওয়ায় সেই সিড়ি টপকানোর মধ্যেই জীবনে কিছু হওয়া বা না হওয়া নির্ধারন করা হয়।

আমরা সবাই জীবন কে ২+২ = ৪ করে হিসাব করে অভ্যস্থ। কিন্তু জীবনের এই হিসেব ১+১+১+১ বা ১+৩ কিংবা ৩+১ সমান চার হতে পারে, সে হিসেবে আমরা অনভ্যস্ত। আমরা অস্বস্তি বোধ করি। 

জীবন কখনো কাউকে প্রতারিত করে না, বরং ব্যক্তির কাছেই জীবনই পরাজিত হয়।  

জীবন কোন সুনির্দিষ্ট পথে হাটার কথা নয়, যদিও আমরা টেনে হেছড়ে নেই। জীবনের ক্ষরন হয়, এক সময় সেই পথে হাটার, দৌড়ানোর সক্ষমতা আসলেও সেটা হয় কেবল বাধিত হওয়ার সূখ, জীবন নিজে আনন্দিত হয় না।

জীবনের জঠিলতার কারনে কাংখিত পথে হাটা সম্ভব হয় না, কিন্তু তার মানে এই না যে নিজের স্বকীয়তা বিলুপ্ত করে দিতে হবে, আটপৌড় হয়ে যেতে হবে। জীবন মানে অনির্দিষ্টতা, নির্দিষ্ট খাপে বাক্সে ভরে তাকে বয়ে নিতে হবে তার কোন মানে হয় না, আর যদি হয়ও, খাপ বা বাক্সের ভিতরের অস্তিত্যটা যেন নিজেই খাপ খাওয়াতে গিয়ে খাপের সাথে, বাক্সের মধ্যে একাকার হয়ে না যায়। বাক্সের মধ্যে জীবন আর বাক্সবন্ধি হওয়া এক কথা নয় 

জীবনের আনন্দ, সূখ, লোভ, পুন্য, দু;:খ, কষ্ট, সৌন্দর্যরূপ, কদর্যতা, নীচতা, হীনতা- সবই আপেক্ষিক।

আপেক্ষিকতা কে বড় করে দেখে তাকে জীবনের ‘স্টান্ডার্ড’ হিসেবে মেনে নেওয়ার কোনই যুক্তি নেই।

সুতরাং- 

Have the Most of it, Just be Honest with yourself.

মানুষ, শত্রু মানুষ

একদিন মানুষের শ্ত্রু ছিলো বন্য জীবজন্তু ও সাপ। আজ মানুষের শত্রু মানুষ। মানুষের বড় প্রতিযোগিতা কে সবচেয়ে শক্তিশালী ও মারণাস্ত্র তৈরী করতে পারে। এইমাত্র যে শিশুটি জন্মগ্রহন করলো তার জন্য একফোঁটা দুধ বরাদ্ধ নেই অথচ তাকে হত্যা করার জন্য বরাদ্দ রয়েছে লক্ষ্য কোটি ডলার পাউন্ডের অস্ত্র।

অন্ধকারে অন্য আলো

বৈশাখ আসতে আরো কিছুদিন বাকী, কিন্তু আকাশের গর্জন আর বিদ্যুত চমকানো দেখে মনে হল, বৈশাখ এসেই গেল! কাল বৈশাখী ঝড়ও কম যায় না, জানালার কপাঠ আর টিনের চালে শীলা বৃষ্টির গান, ভয় আর ভালোলাগার সংমিশ্রনে রাত জেগে থাকার বাহানা !   

 

এপ্রিল ফুল অথবা এপ্রিল ফ্রানক

১৪৯২ খৃঃ পহেলা এপ্রিল বিশ্ব মুসলিমের জন্য এক মর্মান্তিক দিবস। ১৪৬৯ খৃঃ এরাগন রাজ ফার্ডিনান্ড এবং ক্যাষ্টাইলের রানী ইসাবেলার পরিনয়ের পর স্পেনে খৃষ্টানগন শক্তিশালী হতে থাকে। মুসলিমদের মধ্যে দেখা দেয় বিশ্বাসঘাতকা, সৃষ্টি হয় আত্বঘাতী ভ্রাতৃযুদ্ধ ও খ্রীষ্টানদের সাথে বন্ধুত্ব। কর্ডভা, সেভিল, ভেলেলিয়া ইত্যাদি পতনের পর সম্মিলিত খ্রীষ্টান শক্তি মুসলিম সভ্যতার জ্ঞান বিজ্ঞানের কেন্দ্রস্থল গ্রানাডা রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। গ্রানাডার শেষ রাজা আবুল হাসানের পুত্র আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ (বুয়াবদিল নামে কুখ্যাত) এক যুদ্ধে বন্দী হয়ে ফার্ডিনান্ডের প্রতারনায় তারই সংগে যোগ দিয়ে পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে এবং ফার্ডিনান্ড ইসাবেলা বন্ধুরাজ হিসেবে ৩রা জানুয়ারী ১৪৯২/ ২রা রবিউল আউওয়াল ৮৯৭ হিঃ গ্রানাডা দখল করে ফার্ডিনান্ডের হাতে তুলে দেয়। এ কাজে তাকে সাহায্য করেছিল তার মা আয়েশা। স্ত্রী ও সন্তানের বিশ্বাসঘাতকতায় পরাজিত গ্রানাডারাজ আবু হাসান ভ্রাতা আল জাগাল এর পক্ষে সিংহাসন ও রাজ্য ত্যাগ করেন। গ্রানাডা পতনের পর বিশ্বাসঘাতক বুয়াবদিলের মীরজাফরের ন্যায় পুতুল নবাব হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। বৃত্তিভোগি হিসাবে সে বিতাড়িত হয়। কিন্তু খ্রীষ্টন্দের বিরুদ্ধে এলাকা ভিত্তিক বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত যুদ্ধ চলতে থাকে। বিজয়ী ফার্ডিনান্ড ঘোষনা করেন যে, দেশের মুসলিমগন অস্ত্র ত্যাগ করে ১লা এপ্রিল (১৪৯২) মসজিদে আশ্রয় নিলে ক্ষমা প্রাপ্ত হবে ও অত্যাচারিত হবে না। মসজিদে মসজিদে আশ্রয় গ্রহনকারী নিরস্ত্র প্রতারিত মুসলিমদের উপর সারাদেশে পরিকল্পিত হামলা শুরু হয়। মসজিদ গুলোতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। আক্রমনে প্রায় ৭ লক্ষ মুসলিম নরনারী ও শিশু হত্যা করা হয়। অবশিষ্টরা ধর্মান্তরিত হয়ে আত্বরক্ষা করে। এ হত্যাকান্ড যদিও গ্রানাডার বড় মসজিদে কামান দাগিয়ে, অগ্নিসংযোগে ১লা এপ্রিল ১৪৯২ সালে শুরু হয়েছিল, একই নীতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে স্পেনের অন্যান্য শহরে ও জনপদে অনুষ্টিত হয়।

মুসলিমদের সাথে এ প্রতারনার স্মৃতি হিসাবে প্রাশ্চাত্যে আনন্দ দিবস হিসেবে ‘এপ্রিল ফুল’ পালিত হয়। ইদানীংকালে এটি এপ্রিল ফ্রানক হিসেবেও ব্যপকভাবে পালিত হচ্ছে.

নীল বৃষ্টি

নার্স রাতের শেষ ঔষুদটা খাইয়ে দিল কিছুক্ষণ আগে। জানতে চেয়েছিল আর কিছু লাগবে কিনা। ম্লান একটা হাসি দিয়েছি। এর দুটো অর্থ। না এবং তোমাকে ধন্যবাদ। দিনের পর দিন এখানে থাকতে থাকতে এই সব অর্থ তারা ঠিক বুজে নিতে পারে। গুড নাইট বলে বিদায় নেয় নার্সটি। যদিও তারা জানে এই ওয়ার্ডের কেবিনের মানুষদের গুড নাইট আসে না। মাজ রাত্রিতে শরীরের সাথে লাগানো ডজন খানেক তারের অপর প্রান্তে লাগানো মেশিনটা যখন বিপ বিপ করে উটে, সত্যিই তখন সেটা আর গুড থাকেনা। সেকি ব্যস্ততা রুগীকে নিয়ে। আমার নিজের ক্ষেত্রেই কয়েকবার হয়েছে। তবে নিজের ক্ষেত্রে এইসব কিছুই মনে থাকেনা, আবছা আবছা বিশেষ কিছু মুহূর্ত ছাড়া। তবে আমার পাশের ‘সাথী’দের যখন সেরকম পরিস্থিতি আসে তখন বুজতে পারি। মধ্যখানে পর্দা থাকায় সেটা যদিও দেখা যায় না তবে তাদের কথা বার্তায় ঠিক বুজতে পারি। আমরা এই ওয়ার্ডে মোট তিন জন। আমি মধ্যখানে, ডানপাশে একজন মহিলা বয়স ৯২, বাম পাশে ৬৭ বয়সের একজন পুরুষ। একমাত্র আমিই তুলণামুলকভাবে কম বয়সের। আচ্ছা তুলনামূলক বলছি কেন? আমার বয়সটা কি সত্যিই কম না?
মাথার উপর অনুজ্জ্বল আলোটা একটু বাড়িয়ে দেই। গতকাল ওঁর দিকের এক আত্মীয় আমাকে দেখতে আসেন, তিনটা বাংলা বই নিয়ে আসেন সাথে। আসলে ইংল্যান্ডে আসার পর বাংলা বই ছোঁয়া তো দুরের, চোখেই দেখিনি। তাই উনার হাতে বই দুটি দেখে এতই আশ্চর্য হয়ে ছিলাম যে উনাকে ধন্যবাদটুকু দিতে ভুলে গিয়েছি। আমার তো কল্পনায়ই আসেনি এই হাসপাতালে শুয়ে বাংলা বই পরতে পারব।
বইটি খুলে আমি ধাক্কা খেলাম, পৃষ্ঠার লাইন গুলো প্রায় অস্পষ্ট। হাত দিয়ে চোখ কচলিয়ে নিলাম। এই রোগটাতো আমার সব কিছুই কেড়ে নিচ্ছে। বেঁচে যদিওবা যাই কি নিয়ে বেঁচে থাকব? হাত থেকে বইটি নামিয়ে বালিশের কাছে রেখে দেই। মাথার উপরের রিডিং লাইটা নিবিয়ে দেই। বারান্দার আলো রুমটা সম্পূর্ণ অন্ধকার হতে দেয়নি। কিন্তু আমার চোখ? সেতো কেবল অন্ধকারই দেখে। গত এক বছর থেকে সেই অন্ধকার দেখে আসছে। ‘বোন ক্যান্সার’ এ আক্রান্ত প্রতিটি দিন অন্ধকারের ছায়ায় ঘেরা।
আচ্ছা আমার কি এখন এই হাসপাতালের বেডে শুয়ে এইসব ভাবার কথা? আমারতো……। চোখ বন্ধ করি আমি। আমার পেটের বাচ্চাটা বাসায় কেঁদেই যাচ্ছে, আর আমি?
পেটের বাচ্চাইতো! নির্ধারিত তারিখের ২ মাস আগেই তাকে পৃথিবীতে নিয়ে আসা হল। সাথে নিয়ে আসল হাজারটা প্রবলেম, রাখতে হল আই সি ইউ তে তিন সপ্তাহ। আমার নিজেকেও থাকতে হল সপ্তাহ দুই। আমি যখন হাসপাতাল থেকে রিলিজ হলাম, সবারই মত আমারও ভালো লাগার কথা, কিন্তু লাগেনি। মায়েরা হাসপাতালে যায়, পেট কাটে, দু চার দিন পর বাচ্চা নিয়ে বাসায় চলে আসে। আর আমি, কতদিন পর বাসায় যাচ্ছি, তাও আবার বাচ্চা ছাড়া। হায় আল্লাহ, সেটাওতো আমি মেনে নিয়েছি।
তার পরই জানতে পারলাম আমার অসুস্থতার কথা। প্রথম দিকে খুব খারাপ লাগত, সব সময় ক্লান্ত লাগত, ভাবতাম মাত্রইত বাচ্চাটা প্রসব করেছি (আসলে বাচ্চাটা সিজারিয়ান হয়েছে, এটাকে কি বলা যা? বাচ্চাটা মাত্র সিজারিয়ান করিয়েছি? শুনতে খারাপ লাগেনা!) তারপরও অসুস্থতার মধ্যেও দিনগুলো ভালো কাটছিল। বাচ্চাটাকে প্রতিদিন দেখতে যেতাম। তার উপর আমার ডাক্তার, টেস্ট ইত্যাদি প্রায় দিনই থাকত। সপ্তাহ দুই পরে বাচ্চাটা বাসায় আসল, কিন্তু ততদিনে আমি আর আমার থাকলাম না। শুধুই শরীরটা নিয়ে কোনভাবে চলছিলাম। যদিও সেই চলাকে কতটুকু ‘চলা’ বলা যায়। বাচ্চাটা কাঁদতেও পারেনা ভালো করে। নিজের কাছে খুব খারাপ লাগত, নিজের স্বার্থের জন্য দুধের বাচ্চাটাকে বাসায় রেখে…… ইস! ‘বিড়ালটা কেমন করে যে মিট মিট করে তাকায়। বুকটা ভেঙ্গে যায়। হাসপাতালে ভর্তি হবার পর প্রথম দুদিন আমার শাশুড়ি ‘বিড়াল’ টাকে এনেছিলেন, যাবার সময় সেই একই চাহনি। তাই আমিই বলে দিয়েছি বাচ্চাটাকে না আনতে।
বাহিরে কি বৃষ্টি হচ্ছে? হতেও পারে। বুজার উপায় নেই। এমনকি সারা শহর যদি ধ্বংস হয়েও যায়, এই বেডে শুয়ে বলা যাবে না। বাহিরের জগতের কথা কেবল জানতে পারি ও’ যখন আসে। ও’ মানে আমার স্বামী। শুধু স্বামী বললে ওঁর প্রতি অবিচার করা হবে। ও’ত স্বামী’র স্থান ছেড়ে অন্য এক স্থানে চলে গেছে যেটা কেবল আমি জানি। একজন মানুষ আরেক জন মানুষের জন্য নিজের সবটুকু বিসর্জন করতে পারে আমার সেটা জানা হল ওঁকে দেখে। কি এক আশ্চর্য মনোবল দিয়ে ওঁ আমাকে আগলে রাখছে। ওঁ পাশে না থাকলে….; যাহ্‌ কেন যে বার বার অশ্রু আসে চোখে। ওঁকে আমি কোনভাবেই এই পানি দেখাতে চাই না। একটা মানুষ তার স্ত্রী কে হাসি খুশি রাখার এমন কোন চেষ্টা বাকি রাখছেন সেখানে কেন আমি আমার চোখের পানি দেখাব? ওঁর আমাকে নিয়ে ব্যস্ততা দেখে ইচ্ছে করে ওঁকে বলি ‘তুমি কেন এতসব করে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছ, তারচেয়ে আমার পাশে এসে বসে থাক’। কিন্তু বলি না। থাক না, একটা মানুষ যখন এতে আত্বতৃপ্তি পাচ্ছে, তার মৃত পথ যাত্রী স্ত্রীর প্রতি এতটুকু করার সুযোগ নিচ্ছই আমার দেওয়া উচিত। অবশ্য ওঁ যে চায় না, তা না, মাজে মধ্যে পাশে এসে বসে আমার হাত নিয়ে নাড়াচাড়া করে। আমি বুজি, লজ্জায় ওঁ আমার হাত কে তার হাতের মধ্যে মুষ্টি বদ্ধ করতে পারেনা। আমার খুব হাসি পায়। নিজের স্ত্রীর হাত ধরতে এত লজ্জা! আচ্ছা ওঁ কি আমার চলে যাওয়ার পর আরেকটা বিয়ে করবে। আমি জানি ওঁ করতে না চাইলেও থাকে করতে হবে। ওঁর ফ্যামিলিও চাপ দিবে, তাছাড়া ‘দুধের বাচ্চাটাকে’ কে দেখবে? আচ্ছা আমি কি সত্যি সত্যিই মারা যাচ্ছি? ডাক্তাররা আমাকে কিছু বলেনা, তবে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে মাজে মাজে আমি বুজতে চেষ্টা করি। একটা ডাক্তার আছে, বয়স অনুমান করা কঠিন, চুল ভ্রু একদম সাদা, কিন্তু হাতের মুখের চামড়ায় একটুও ভাঁজ নেই। এই ডাক্তার মাজে মধ্যে আসেন। বুজতে পারি খুব উপরের স্তরের স্পেশালিষ্ট। আমার যখন অসুস্থতা বেড়ে যায় তখন উনি এসে দেখে যান। লোকটা মাজে মাজে এমন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আমি কিছু বলতে পারিনা, কিন্তু কেন জানি মনে হয় তিনি আমার দিকে থাকিয়ে নিঃশব্দে কিছু বলছেন। আচ্ছা উনি কি আমার মৃত্যু নিয়ে মোটা মোটি নিশ্চিত?
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকতে আমার তেমন খারাপ লাগে না। ভাবছেন পাগল আমি? না, আসলেই আমার খারাপ লাগে না, শুধু অসুস্থতা যখন বেড়ে যায় ঐ মুহূর্তগুলো ছাড়া তেমন কোন ক্লান্তি নেই। এক গেয়েমি লাগেনা? খুব লাগে, তবে আমি লাগতে দেইনা।
আমি আমার স্মৃতির প্লেয়ারটাকে রেওয়াইন্ড করে দেই। আমার শৈশব, কিশোরী জীবন, কলেজ জীবন।
মফস্বল শহরে বেড়ে উঠা আমাদের, আমাদের এক ভাই আর দু বোনের মধ্যবিত্ত পরিবারে। বাবা ছিলেন আমাদের স্থানীয় এলাকার ইউনিয়ন মেম্বার। বোনটা আমার বড়, আমার ছোট ভাই আর আমি পিটাপিটি। খুব ভালই যাচ্ছিল সময়গুলো। এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ। বাবা মা’র কথা কানে আসে। আমার বিয়ের আলাপ আসছে!
এবং শেষমেশ বাসায় এসে কনে দেখা! দেখার অবশ্য কিছু ছিল না। কারন দেখতে আমি মোটামুটি সুন্দরীই ছিলাম! দেখতে এসে ফিরে যাবে এই রকম সম্ভাবনা কম ছিল।
আপু, তোর কি ভাগ্য, সুন্দরী মেয়ে, লন্ডনী বর পেয়ে গেলি কত্ব সহজে! – বলেছিল ছোট ভাইটি আমার।
– তুইও কি তাই মনে করিস, আমার চেহারাই আমার লন্ডনী বর পাওয়ার একমাত্র কারন!
কিছুটা আমতা আমতা করে বলল; ঠিক তা না, বাদ দে, অন্তত বিয়ে তো হচ্ছে, আমার তো সে চান্স নাই। পড়াশুনা শেষ করতে হবে, না হয় কিছু একটা করে নিজের পায়ে দাড়াতে হবে- তার আগে বিয়ে করা যাবে না! কেমন লাগে বলত!
-অরে বিয়ে পাগল, বলব নাকি মা’কে যে তার ছেলের বিয়ে করতে মুন চায়! নাকি কাউকে বিয়ের আশায় বসিয়ে রেখেছিস!- বললাম আমি !
-ধ্যাত, তুমি কি যে বল না! যাও, নিজের বিয়ে নিয়েই এখন ভাব গিয়ে, আমারটা না ভাবলেও চলবে।
আমরা যত না ছিলাম ভাই বোন তার চেয়ে বেশি ছিলাম বন্ধু!
কি কান্নাটাই না করল আমার বিদায়ের দিন।
আপু, তুমি সত্যিই চলে যাবে! আমি ঠিক মেনে নিতে পারছিনা! কি দরকার ছিল তোমাকে লন্ডনী বরের কাছে বিয়ে দেয়ার! আমার আর কোন বন্ধু থাকল না! আমি এখন কাকে নিয়ে বিকেলে চা খাব! ছাদে আড্ডা দিব! আমার সারাদিনের কর্মযজ্ঞ কি আগ্রহ করে শুনবে! আপু তুমি সত্যি চলে যাবে?
কি বলতে পারি আমি তাকে? আমার বুকের যে চিন চিনে ব্যথা আর হাহাকার, আমি কিভাবে বলতে পারতাম তাকে।
পাগল! মনে হচ্ছে আমি চিরদিনের জন্য যাচ্ছি? আর তর দুলাভাই তো বলেছেই সেখানে গিয়ে তকে নেওয়ার একটা ব্যবস্থা করবে। – তার সেই বিষাদের কথাগুলোর প্রতিদত্তরে বলেছিলাম আমি।
-নারে আপু, আমি তোকে হারিয়ে ফেলছি! আমি চাইনা আর তকে ফিরে পেতে!

কি অদ্ভুত দার্শনিক কথাগুলো ছিল আমার ভাইটার।কি অসহ্য ছিল কথাগুলো! আমি আজও সে মুহূর্তের অনুভূতিকে চোখের পানিতে শোধ দিতে পারিনি।

না, এর পর আর দেশে যাওয়া হয়নি। যাচ্ছি যাচ্ছি করে যাওয়া হল না! আসলে যাওয়াটা আমার কাছে নয়! আমার স্বামীদের তেমন কোন আত্বীয় নেই
যে সে টানে দেশে যাবেন। এখন যাওয়া বলতে আমার বাবা মা ভাই বোনদের দেখতে যাওয়া। তাই, দেশে যাওয়ার জন্য মনটা চট পট করলেও মুখ দিয়ে ওকে বলতে পারি নি দেশে বাবা মা, ভাই বোনদের দেখতে যেতে চাই। আমি অপেক্ষা করছিলাম ও’ নিজ থেকে বলুক।
আমি শুধু কল্পনা করে যাই, আমাদের সেই সব দিনগুলোর কথা।
‘আপু, টাকা দে’। এল আর বি’র নতুন এলবাম এসেছে!’ আসলে ও এল আর বি’র গান এতো শুনতে যে তার সাথে সাথে আমি এক সময় এল আর বি’র গানের ভক্ত হয়ে গেলাম! তাই আমরা দুজন শেয়ার কিরে ক্যাসেট কিনতাম। ও’কি এখনো শুনে এল আর বি’র গান- ‘এখন অনেক রাত’ কিংবা ‘অসুস্থ আমি এক হাসপাতালে’।
আমার চোখের পানি গড়িয়ে পরে। কি যে এক প্রশান্তি। সত্যি আমার খারাপ লাগে না। মাজে মাজে ও’ আমার গালের পাশে চোখের পানি দেখ ঘাবড়ে যায়!
-প্লিজ, তুমি মনোবল হারিয়ে ফেলনা। তোমার এই অসুখটা থেকে ভাল হতে যত না শারীরিক শক্তির প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন মানসিক বল। ডাক্তারও তো সেই কথা বলেছে!
আমি হাসি! কি বলব। আমার চোখ দিয়ে কেন পানি আসে সেটা কি ও’কে বুজানো যাবে!
আমি ও’কে আমার পাশে এসে বসতে বলি!
-কি? তোমার ইচ্ছা হয়না?
-কি ইচ্ছে হয়না!
-আমাকে আদর করতে, ভালোবাসাবাসি করতে?
ও’আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
আমি তার সে তাকানোটাকে উপভোগ করি।
বেশি রাত হয়ে গেলে ও হাসপাতালে থেকে যায়। আমরা সারারাত গল্প করি! ও’র মোবাইলে স্টোর করা আমাদের বিয়ের পর থেকে তোলা সকল ছবি একটি একটি করে দেখি।
আমরা প্লান করি বাচ্চাটা আরেকটু বড় হয়ে গেলেই এবার দেশে যাব। কি কি কেনা কাটা করতে হবে তার একটা রাফ করি।
আসলে এরকম রাত খুব কম আসে যখন আমরা আমাদের প্ল্যান শেষ করতে পারি! আমি ক্লান্তিতে নেতিয়ে পরি কিংবা শরীরের সাথে লাগানো মেশিন বিপ বিপ করে উঠে! আমার সামনে বসা কিংবা আমার মাথার কাছে বসা মানুষটি ঝাপসা হয়ে আসে! ঝাপসা হয়ে আসে আমার চারপাশ! দেয়ালের পেন্টিং,পর্দা। তখন একটাই কথা মনে হয়- কেবল মনে হয় এই ঝাপসা হয়ে আসাটাই স্থায়ী হবে চির অন্ধকার হিসেবে। আমি যেন তখন ‘অন্ধকার থেকে অন্তহীন আধার খুঁজি!’

ছুটি!

ছুটি! শব্দটা শুনলেই ভেতরে কেমন একটা মুক্তি মুক্তি ভাব আসে। হোক না সেটা অল্প কিছু মুহুর্তের, অল্প কিছু দিনের। আমাদের পলায়ন প্রিয় মন কি এত কিছু ভাবে?

আমাদের সবার ক্ষেত্রেই ছুটির প্রতি কম বেশি দুর্বলতা রয়েছে।
আর ছুটির প্রতি আমাদের এই দুর্বলতার শুরু সেই ছোট্ট কাল থেকে। ছুটির প্রতি দুর্বলতা বয়সের সাথে সাথে যেটি হয় সেটি হচ্ছে অবস্থানের স্থানান্তর। আরো একটু নিরস ভাবে বললে- সেটা হচ্ছে ‘খাঁচার পরিবর্তন’।
আমার ‘প্রথম মুক্তির’ বা তীব্র ছুটির ইচ্ছার জন্ম হয়ে ছিল আরবি শিক্ষার কালে। ‘মক্তব’ শেষের ছুটি। ‘মেসাবজির’ বেত খাওয়া থেকে ছুটির পাওয়াটাই ছিল সর্বাগ্রে। কান দুটো সব সময় মেসাবজির ‘যাও, আইজ ছুটি’ শুনার প্রতিক্ষায় থাকত। আরেকটা ব্যাপার ছিল, পড়া পারা না পারার ব্যপার। যে আগে ‘সবক’ দিতে পারত তার আগে ছুটি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকত আগে। আর যে পারত না তার ছুটি পাওয়া ছিল ‘সবক’ দিতে পারা সাপেক্ষ। অনেক ক্ষেত্রে কোরান শরীফ পড়ুয়ারাদের কায়দা সিফারা পড়ুয়াদের সবক নেয়ার দায়িত্ব পরত।
এর পর যে মুক্তির ইচ্ছা প্রবল ছিল ‘ক্লাস মুক্তি’। বিশেষ কোনো বিষয় বা স্যারের ক্লাস থেকে মুক্তির। এমন দিন ছিল যখন কায়মনে প্রার্থণা করতাম বিশেষ কোন ক্লাস যেন না হয়, ছুটির ঘন্টা যেন পড়ে তার আগে।  
সেইসব তো অনেক আগের কথা। আমরা অনেকেই ভুলে যাই, ভুলে গেছি সেই সব পুরনো ছোট খাট আনন্দের অনুভূতি। তাই বলে কি আমাদের ছুটির আকাঙ্ক্ষা  কমে?
বয়সের সাথে সাথে ছুটির আকাঙ্ক্ষা  যেন তীব্রতর হয়। হয়ত প্রকাশ ভিন্ন। আমাদের কারো কারো মধ্যে প্রকাশ পায় দীর্ঘশ্বাসের ভেতর দিয়ে।
জীবনের চাকা ঘুড়াতে গিয়ে যখন জীবন হাঁপিয়ে উঠে, চারপাশ থেকে ছুটি নেওয়ার জন্য মন ছটফট করে।
সেই ছাত্র জীবন থেকে শুরু করে ছুটির তৃঞ্চা বাড়ে বৈ কমে না।
পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে কর্ম ক্ষেত্রে প্রবেশ করে আমাদের মনকে যেন ছুটির নেশায় পেয়ে বসে। সপ্তাহ শেষে নির্দিষ্ট দিনের ছুটির অপেক্ষায় মন প্রাণ গলা কাটা মুরগীর মত চটপট করে। কখনো কখনো কাজের প্রতি প্রচন্ড বিতৃষ্ণায় মন বিষিয়ে উঠে। তখন লম্বা একটা ছুটির চুরি বুকে আছড় কাটে।
আবার এমনও হয়, যে মায়া আর মহব্বত দিয়ে গড়া ঘর সংসার- কারো কারো পলাতক মন সেই ঘর সংসার থেকে ছুটি পেতে চায়। সাংসারিক চাহিদা, জীবনের চাওয়া পাওয়ার হিসাব মিলাতে গিয়ে অনেকেই হাপিঁয়ে উঠেন। তখন বুকের ভেতর এক স্বার্থপর ছুটির আকাঙ্ক্ষা  জন্ম নেয়।
এই ছুটির পিছনেই যেন জীবন। আর একদিন সেই জীবনের কাছ থেকেই ছুটি নিতে প্রস্তুত হতে হয়। বার্ধক্য কিংবা অসুস্থতায়, জীবনের চাকা অনেকটা যখন শীতল হয়ে আসে, মানব মন প্রস্তুত হয় চির দিনের জন্য ছুটি নিতে। কিন্তু সেই পুরাতন বাধা। ছুটি চাইলেই কি ছুটি পাওয়া যায়? কেউ কি তার নিজের ছুটি নিজে দিতে পারে? তাই অপেক্ষা…..
বয়স ভেদে ছুটির আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা কম বেশি হতে পারে কিন্তু মনের কোণে তার উপস্থিতি কেউই অস্বীকার করতে পারি না।
আমার মনে হয়, স্বপ্ন, আশা ইত্যাদিরর মত ছুটির আকাঙ্ক্ষাও মানব জীবনকে সচল রাখতে টনিক হিসেবে কাজ করে। স্বল্প কিংবা দীর্ঘমেয়াদী ছুটির আকাঙ্ক্ষা জীবনভরই থেকে যায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সকল ছুটির আকাঙ্ক্ষা একটি ছুটিতে এসে থেমে যায়। জীবন থেকে ছুটির। কেবল অন্তিম ছুটির ঘন্টাই পারে সকল ছুটির আকাঙ্ক্ষা থেকে ছুটি দিতে……..

জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব

অভিবাসী সংকট নাকি মানবিক সংকট

বছর ব্যাপী যে দুর্বিষহ সংবাদ আমাদেরকে প্রায় প্রতি সপ্তাহ কিংবা মাসে শুনতে এবং পাশাপাশি করুণ পরিণতি’র সাক্ষী হয়ে নির্বাক থাকতে হয়েছে এবং হচ্ছে, সেটি হচ্ছে অভিবাসীর করুণ মৃত্যু। গত কয়েক সপ্তাহে সেটি এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এটি নি:সন্দেহে বর্তমান বিশ্বের মানব ইতিহাসের অন্যতম দুর্যোগ হিসেবে ইতিমধ্যেই ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে।
কিন্তু দু:খ জনক এবং লজ্জার বিষয় হচ্ছে মানবিক এই দুর্যোগ কোন প্রাকৃতিক কারনে নয়, বরং মানব সৃষ্ট।
এই মানবিক দুর্যোগ আপাত দৃষ্টিতে আঞ্চলিক বলে মনে করে অনেকেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিচ্ছেন, সমালোচনা করছেন সেই সকল দেশের মানুষ এবং রাষ্ট্রীয় কোন্দলকে।
হ্যাঁ, বাহ্যিক দিক থেকে সেটি সত্য কিন্তু পরম সত্য নয়।
বিশ্ব রাজনীতির কালা থাবা আর আধিপত্য বিস্তারের গিনিপিগ হিসেবে যখন কোন দেশের জনগন, রাষ্ট্র ও সরকার কাজ করে তখন সেটি আর আঞ্চলিক বা স্বদেশীয় ‘মেটার’ থাকেনা। তাই আজকের এই মানবিক বিপর্যয় মোটেই আর গোটি কয়েকটি দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়, এটি সমগ্র পৃথিবীর অন্যতম দুর্যোগ।
কিন্ত আমরা কি দেখছি? দেখছি যাদের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কথা, যারা পারত এবং পারা সম্ভব এই সকল মানব সন্তানদের সাগরে মর্মান্তিক মৃত্যু অথবা শ্বাস রুদ্ধ হয়ে করুনভাবে জীবনের সকল কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়া থেকে বিরত রাখতে তার বাড়িয়ে দিচ্ছে সীমান্তে কঠোর নিরাপত্তা। তাদের এই অমানবিক, অমানুষী আচরন কে কিছুটা মানবিক প্রলেপ দিতে তারা ব্যবহার করছে ‘অভিবাসী সমস্যা’।
যে ইউরোপ মানবাধিকার নিয়ে সমগ্র পৃথিবীকে থাপড়িয়ে বেড়াচ্ছে, আমরা দেখছি তাদের সমুদ্র সীমানা আর স্থল সীমান্তে অসহায় নারী আর শিশুদের ভাসমান আর গলিত লাশ!
প্রশ্ন জাগে, তাদের কেন এত অনিহা এই মানব সন্তানদের কে নিজেদের দেশে আশ্রয় দিতে? তাদের কে রক্ষা করতে হাত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে কেন এত ধীর যেখানে অন্য দেশে বোমা আর ড্রোন আক্রমণ চালাতে তড়িৎ?
বর্ণ, ধর্ম, আঞ্চলিকতা- এই সব শব্দ বলা হচ্ছে আজকের আধুনিক পৃথিবীর অভিধান থেকে উঠে গেছে কিন্তু আমরা দেখছি সেটি বরং আরো অশ্লীলভাবে কর্ম, আচরন এমনকি কথায় উপ্রোতভাবে উপস্থিত।
মানুষের কাছে তার জীবন সবচেয়ে বেশি মুল্যবান। জীবনকে বাচিঁয়ে রাখার জন্য এমন কোন উপায় বা অবলম্বন নেই যা সে তার সে নিশ্বাস থাকা পর্যন্ত চেষ্টা করবে না। অথচ আমরা দেখছি এই সব মানব সন্তান নিজের সেই জীবনকেই বাজি রাখছে জীবনকে রক্ষা করার জন্য। ইউরোপে যারা পাড়ি জমায়, একটা সময়, সেটি ছিল অপেক্ষাকৃত ভাল জীবনের সন্ধানে। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় সেটি ভাল জীবন নয়, বরং ইউরোপ মুখী যাত্রা বেঁচে থাকার শেষ প্রচেষ্টার অংশ মাত্র। আবার এও বলা যায়, তাদের এ অনিশ্চিত যাত্রা অনেকটা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার স্থান পরিবর্তন। মৃত্যু যেখানে নিশ্চিত এবং স্থান পরিবর্তনে মৃত্যুর হাত থেকে কিছুটা দুরত্বই এই ‘অভিবাসী’দের একটা ফ্যান্টাসি?!!!!
আমরা সূবিধাভোগীরা আহঁ, হু আর কিছুটা মায়া কান্না করেই নিজেদের অবস্থান কতটা ‘স্থিতিশীল সেটাই হয়ত অনুভব করার চেষ্টা করি! আর পৃথিবীর হর্তা কর্তারা এক হাতে হুস্কি আর অন্য হাতের বগলে হুকারদের জড়িয়ে শীৎকার করে বলে…. We must Do Something

জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব

বিশ্বাসহীন বিশ্বাসী

মাজে মাজে ভাবি, আসলেই কি কেউ ‘প্রকৃতিগতভাবে অবিশ্বাসী’ হতে পারে? আর যদি কেউ হয়েও থাকে, সেটা কিভাবে বাস্তব সম্মত? ধর্মের বর্ণিত সৃষ্টিকর্তা ধারণার সাথে নিজে কেউ ভিন্নতর মত পোষণ করতে পারে কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ধারণার সাথে যে অদৃশ্য শক্তির সহাবস্থান, তা অস্বীকার করার মত জ্ঞানী বা যুক্তিবাদী কেউ আছে বলে আমার মনে হয় না।
আমার প্রিয় একজন কাষ্টমার, রক এন্ড রল আইডল, টপ টু বটম। যার দাড়ি নেমে পেঠের নিম্নাংশ পর্যন্ত প্রলম্বিত। সাধারণত আমার ধারনা ছিল যারা রক এন্ড রল টাইপ, প্রচন্ড শব্দের মোটর বাইক চালায় তারা রুক্ষ হয়, ব্যবহারে হয় আগ্রেসিভ। কিন্তু এই লোকটার সাথে পরিচয় হওয়ার পর আমার সে ধারণায় চির ধরেছে। সেই যাই হোক।
লোকটির সাথে আমার প্রায়শই ধর্ম সমাজ রাজনীতি নিয়ে কথা হয়। এমনকি বর্ণবাদ নিয়েও।( বলে রাখা ভাল, লোকটির অরিজিন সাউথ আফ্রিকা, এবং শ্বেতাঙ্গ।)
এই লোকটির সাথে যুক্তি তর্কের এক পর্যায়ে আমার নিজের নতুন এক উপলব্ধি জন্ম নিল? ঐ, আসলেই কি কেউ ‘পরম অবিশ্বাসী’ হতে পারে? না পারে না। সে যতই আধুনিক ধারণার সাথে পরিচিত হোক, বিজ্ঞানের চরম অনুগত হোক না কেন, তার দৈনিক জীবনের অধিকাংশ সময়ই কাটে বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে।
আবার যদি বলা হয় বিশ্বাস আর আস্থা এক নয়, তবে সেটা ধরে নিয়েও কেই কি আস্থাহীন জীবন যাপন কিংবা ধারণ করতে পারে? অসম্ভব। 
এই যে রক এন্ড রোল মানুষটির কথা বলছি- সে যদিও প্রচলিত (সাধারণত খিশ্চিয়ান) ধর্মীয় স্রষ্টার ধারণার সাথে ভিন্নমত পোষন করে, কিন্তু একটি অদৃশ্য শক্তিতে সেও বিশ্বাস করে। না সেটি ‘ডেভিল ওয়ারশিপ’ নয়, প্রকৃত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সে সেই শক্তিকে বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে নারাজ যেটাকে সে কখনো বলে ‘সেন্স’ কখনওবা আখ্যায়িত করে নলেজ হিসেবে।
আমরা, আমাদের জীবনটাই সম্পুর্ণ আস্থা বা বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। চারপাশে যে দিকেই তাকাই, দেখি বিশ্বাস আর আস্থার উপস্থিতি। বিশ্বাস আর আস্থাহীন জীবন স্থবির।
হাইওয়েতে ৭০ – ৯০ মাইল গতিতে চলা হাজার হাজার মোটর বাহন চলে বিশ্বাস আর আস্থার উপর। হাজার ফুট উপর দিয়ে চলা বিমান থেকে শুরু করে সাগরে মাছ শিকারি ডিঙি নৌকার মানুষ গুলোর জীবনে দেখি সেই একই আস্থা আর বিশ্বাস। সুউচ্চ অট্টালিকা নির্মানে শত ফুট উচ্চতা থেকে শুরু করে খনির নীচে কাজ করা শ্রমিকরা প্রতিটি দিন শুরু হয় বিশ্বাস দিয়ে।
আর যে জটিল মনস্থাত্ত্বিক সম্পর্কে মানব জীবন গতিময় সেটিও সম্পুর্ণ আস্থা আর বিশ্বাস নির্ভর।
তবে কি করে কেউ দাবী করতে পারে, সে অবিশ্বাসী।
জাগতিক এই বিশ্বাস আর আস্থার গোলকে বন্ধী আমি আমরা হয়ত দ্বিধাগ্রস্ত, শংসিত কিন্তু অবিশ্বাসী? না, সেটি অসম্ভব। অবাস্তব; যদি না কেউ মানসিকভাবে অসুস্থ কিংবা অস্থিরতা দ্বারা প্রভাবিত।
বিশ্বাস আর আস্থার এই সীমাকে কেউ যদি নিয়ে যায় সীমাহীনতায়, অসীম কোন শক্তিতে- অবলীলায় বলা যায়- সে বিশ্বাস আর আস্থা জাগতিক বিশ্বাস আর আস্থার চেয়ে শ্রেয়তর- কিংবা বলা যায় ‘এডভাঞ্চারাস’।