নীল বৃষ্টি

নার্স রাতের শেষ ঔষুদটা খাইয়ে দিল কিছুক্ষণ আগে। জানতে চেয়েছিল আর কিছু লাগবে কিনা। ম্লান একটা হাসি দিয়েছি। এর দুটো অর্থ। না এবং তোমাকে ধন্যবাদ। দিনের পর দিন এখানে থাকতে থাকতে এই সব অর্থ তারা ঠিক বুজে নিতে পারে। গুড নাইট বলে বিদায় নেয় নার্সটি। যদিও তারা জানে এই ওয়ার্ডের কেবিনের মানুষদের গুড নাইট আসে না। মাজ রাত্রিতে শরীরের সাথে লাগানো ডজন খানেক তারের অপর প্রান্তে লাগানো মেশিনটা যখন বিপ বিপ করে উটে, সত্যিই তখন সেটা আর গুড থাকেনা। সেকি ব্যস্ততা রুগীকে নিয়ে। আমার নিজের ক্ষেত্রেই কয়েকবার হয়েছে। তবে নিজের ক্ষেত্রে এইসব কিছুই মনে থাকেনা, আবছা আবছা বিশেষ কিছু মুহূর্ত ছাড়া। তবে আমার পাশের ‘সাথী’দের যখন সেরকম পরিস্থিতি আসে তখন বুজতে পারি। মধ্যখানে পর্দা থাকায় সেটা যদিও দেখা যায় না তবে তাদের কথা বার্তায় ঠিক বুজতে পারি। আমরা এই ওয়ার্ডে মোট তিন জন। আমি মধ্যখানে, ডানপাশে একজন মহিলা বয়স ৯২, বাম পাশে ৬৭ বয়সের একজন পুরুষ। একমাত্র আমিই তুলণামুলকভাবে কম বয়সের। আচ্ছা তুলনামূলক বলছি কেন? আমার বয়সটা কি সত্যিই কম না?
মাথার উপর অনুজ্জ্বল আলোটা একটু বাড়িয়ে দেই। গতকাল ওঁর দিকের এক আত্মীয় আমাকে দেখতে আসেন, তিনটা বাংলা বই নিয়ে আসেন সাথে। আসলে ইংল্যান্ডে আসার পর বাংলা বই ছোঁয়া তো দুরের, চোখেই দেখিনি। তাই উনার হাতে বই দুটি দেখে এতই আশ্চর্য হয়ে ছিলাম যে উনাকে ধন্যবাদটুকু দিতে ভুলে গিয়েছি। আমার তো কল্পনায়ই আসেনি এই হাসপাতালে শুয়ে বাংলা বই পরতে পারব।
বইটি খুলে আমি ধাক্কা খেলাম, পৃষ্ঠার লাইন গুলো প্রায় অস্পষ্ট। হাত দিয়ে চোখ কচলিয়ে নিলাম। এই রোগটাতো আমার সব কিছুই কেড়ে নিচ্ছে। বেঁচে যদিওবা যাই কি নিয়ে বেঁচে থাকব? হাত থেকে বইটি নামিয়ে বালিশের কাছে রেখে দেই। মাথার উপরের রিডিং লাইটা নিবিয়ে দেই। বারান্দার আলো রুমটা সম্পূর্ণ অন্ধকার হতে দেয়নি। কিন্তু আমার চোখ? সেতো কেবল অন্ধকারই দেখে। গত এক বছর থেকে সেই অন্ধকার দেখে আসছে। ‘বোন ক্যান্সার’ এ আক্রান্ত প্রতিটি দিন অন্ধকারের ছায়ায় ঘেরা।
আচ্ছা আমার কি এখন এই হাসপাতালের বেডে শুয়ে এইসব ভাবার কথা? আমারতো……। চোখ বন্ধ করি আমি। আমার পেটের বাচ্চাটা বাসায় কেঁদেই যাচ্ছে, আর আমি?
পেটের বাচ্চাইতো! নির্ধারিত তারিখের ২ মাস আগেই তাকে পৃথিবীতে নিয়ে আসা হল। সাথে নিয়ে আসল হাজারটা প্রবলেম, রাখতে হল আই সি ইউ তে তিন সপ্তাহ। আমার নিজেকেও থাকতে হল সপ্তাহ দুই। আমি যখন হাসপাতাল থেকে রিলিজ হলাম, সবারই মত আমারও ভালো লাগার কথা, কিন্তু লাগেনি। মায়েরা হাসপাতালে যায়, পেট কাটে, দু চার দিন পর বাচ্চা নিয়ে বাসায় চলে আসে। আর আমি, কতদিন পর বাসায় যাচ্ছি, তাও আবার বাচ্চা ছাড়া। হায় আল্লাহ, সেটাওতো আমি মেনে নিয়েছি।
তার পরই জানতে পারলাম আমার অসুস্থতার কথা। প্রথম দিকে খুব খারাপ লাগত, সব সময় ক্লান্ত লাগত, ভাবতাম মাত্রইত বাচ্চাটা প্রসব করেছি (আসলে বাচ্চাটা সিজারিয়ান হয়েছে, এটাকে কি বলা যা? বাচ্চাটা মাত্র সিজারিয়ান করিয়েছি? শুনতে খারাপ লাগেনা!) তারপরও অসুস্থতার মধ্যেও দিনগুলো ভালো কাটছিল। বাচ্চাটাকে প্রতিদিন দেখতে যেতাম। তার উপর আমার ডাক্তার, টেস্ট ইত্যাদি প্রায় দিনই থাকত। সপ্তাহ দুই পরে বাচ্চাটা বাসায় আসল, কিন্তু ততদিনে আমি আর আমার থাকলাম না। শুধুই শরীরটা নিয়ে কোনভাবে চলছিলাম। যদিও সেই চলাকে কতটুকু ‘চলা’ বলা যায়। বাচ্চাটা কাঁদতেও পারেনা ভালো করে। নিজের কাছে খুব খারাপ লাগত, নিজের স্বার্থের জন্য দুধের বাচ্চাটাকে বাসায় রেখে…… ইস! ‘বিড়ালটা কেমন করে যে মিট মিট করে তাকায়। বুকটা ভেঙ্গে যায়। হাসপাতালে ভর্তি হবার পর প্রথম দুদিন আমার শাশুড়ি ‘বিড়াল’ টাকে এনেছিলেন, যাবার সময় সেই একই চাহনি। তাই আমিই বলে দিয়েছি বাচ্চাটাকে না আনতে।
বাহিরে কি বৃষ্টি হচ্ছে? হতেও পারে। বুজার উপায় নেই। এমনকি সারা শহর যদি ধ্বংস হয়েও যায়, এই বেডে শুয়ে বলা যাবে না। বাহিরের জগতের কথা কেবল জানতে পারি ও’ যখন আসে। ও’ মানে আমার স্বামী। শুধু স্বামী বললে ওঁর প্রতি অবিচার করা হবে। ও’ত স্বামী’র স্থান ছেড়ে অন্য এক স্থানে চলে গেছে যেটা কেবল আমি জানি। একজন মানুষ আরেক জন মানুষের জন্য নিজের সবটুকু বিসর্জন করতে পারে আমার সেটা জানা হল ওঁকে দেখে। কি এক আশ্চর্য মনোবল দিয়ে ওঁ আমাকে আগলে রাখছে। ওঁ পাশে না থাকলে….; যাহ্‌ কেন যে বার বার অশ্রু আসে চোখে। ওঁকে আমি কোনভাবেই এই পানি দেখাতে চাই না। একটা মানুষ তার স্ত্রী কে হাসি খুশি রাখার এমন কোন চেষ্টা বাকি রাখছেন সেখানে কেন আমি আমার চোখের পানি দেখাব? ওঁর আমাকে নিয়ে ব্যস্ততা দেখে ইচ্ছে করে ওঁকে বলি ‘তুমি কেন এতসব করে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছ, তারচেয়ে আমার পাশে এসে বসে থাক’। কিন্তু বলি না। থাক না, একটা মানুষ যখন এতে আত্বতৃপ্তি পাচ্ছে, তার মৃত পথ যাত্রী স্ত্রীর প্রতি এতটুকু করার সুযোগ নিচ্ছই আমার দেওয়া উচিত। অবশ্য ওঁ যে চায় না, তা না, মাজে মধ্যে পাশে এসে বসে আমার হাত নিয়ে নাড়াচাড়া করে। আমি বুজি, লজ্জায় ওঁ আমার হাত কে তার হাতের মধ্যে মুষ্টি বদ্ধ করতে পারেনা। আমার খুব হাসি পায়। নিজের স্ত্রীর হাত ধরতে এত লজ্জা! আচ্ছা ওঁ কি আমার চলে যাওয়ার পর আরেকটা বিয়ে করবে। আমি জানি ওঁ করতে না চাইলেও থাকে করতে হবে। ওঁর ফ্যামিলিও চাপ দিবে, তাছাড়া ‘দুধের বাচ্চাটাকে’ কে দেখবে? আচ্ছা আমি কি সত্যি সত্যিই মারা যাচ্ছি? ডাক্তাররা আমাকে কিছু বলেনা, তবে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে মাজে মাজে আমি বুজতে চেষ্টা করি। একটা ডাক্তার আছে, বয়স অনুমান করা কঠিন, চুল ভ্রু একদম সাদা, কিন্তু হাতের মুখের চামড়ায় একটুও ভাঁজ নেই। এই ডাক্তার মাজে মধ্যে আসেন। বুজতে পারি খুব উপরের স্তরের স্পেশালিষ্ট। আমার যখন অসুস্থতা বেড়ে যায় তখন উনি এসে দেখে যান। লোকটা মাজে মাজে এমন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আমি কিছু বলতে পারিনা, কিন্তু কেন জানি মনে হয় তিনি আমার দিকে থাকিয়ে নিঃশব্দে কিছু বলছেন। আচ্ছা উনি কি আমার মৃত্যু নিয়ে মোটা মোটি নিশ্চিত?
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকতে আমার তেমন খারাপ লাগে না। ভাবছেন পাগল আমি? না, আসলেই আমার খারাপ লাগে না, শুধু অসুস্থতা যখন বেড়ে যায় ঐ মুহূর্তগুলো ছাড়া তেমন কোন ক্লান্তি নেই। এক গেয়েমি লাগেনা? খুব লাগে, তবে আমি লাগতে দেইনা।
আমি আমার স্মৃতির প্লেয়ারটাকে রেওয়াইন্ড করে দেই। আমার শৈশব, কিশোরী জীবন, কলেজ জীবন।
মফস্বল শহরে বেড়ে উঠা আমাদের, আমাদের এক ভাই আর দু বোনের মধ্যবিত্ত পরিবারে। বাবা ছিলেন আমাদের স্থানীয় এলাকার ইউনিয়ন মেম্বার। বোনটা আমার বড়, আমার ছোট ভাই আর আমি পিটাপিটি। খুব ভালই যাচ্ছিল সময়গুলো। এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ। বাবা মা’র কথা কানে আসে। আমার বিয়ের আলাপ আসছে!
এবং শেষমেশ বাসায় এসে কনে দেখা! দেখার অবশ্য কিছু ছিল না। কারন দেখতে আমি মোটামুটি সুন্দরীই ছিলাম! দেখতে এসে ফিরে যাবে এই রকম সম্ভাবনা কম ছিল।
আপু, তোর কি ভাগ্য, সুন্দরী মেয়ে, লন্ডনী বর পেয়ে গেলি কত্ব সহজে! – বলেছিল ছোট ভাইটি আমার।
– তুইও কি তাই মনে করিস, আমার চেহারাই আমার লন্ডনী বর পাওয়ার একমাত্র কারন!
কিছুটা আমতা আমতা করে বলল; ঠিক তা না, বাদ দে, অন্তত বিয়ে তো হচ্ছে, আমার তো সে চান্স নাই। পড়াশুনা শেষ করতে হবে, না হয় কিছু একটা করে নিজের পায়ে দাড়াতে হবে- তার আগে বিয়ে করা যাবে না! কেমন লাগে বলত!
-অরে বিয়ে পাগল, বলব নাকি মা’কে যে তার ছেলের বিয়ে করতে মুন চায়! নাকি কাউকে বিয়ের আশায় বসিয়ে রেখেছিস!- বললাম আমি !
-ধ্যাত, তুমি কি যে বল না! যাও, নিজের বিয়ে নিয়েই এখন ভাব গিয়ে, আমারটা না ভাবলেও চলবে।
আমরা যত না ছিলাম ভাই বোন তার চেয়ে বেশি ছিলাম বন্ধু!
কি কান্নাটাই না করল আমার বিদায়ের দিন।
আপু, তুমি সত্যিই চলে যাবে! আমি ঠিক মেনে নিতে পারছিনা! কি দরকার ছিল তোমাকে লন্ডনী বরের কাছে বিয়ে দেয়ার! আমার আর কোন বন্ধু থাকল না! আমি এখন কাকে নিয়ে বিকেলে চা খাব! ছাদে আড্ডা দিব! আমার সারাদিনের কর্মযজ্ঞ কি আগ্রহ করে শুনবে! আপু তুমি সত্যি চলে যাবে?
কি বলতে পারি আমি তাকে? আমার বুকের যে চিন চিনে ব্যথা আর হাহাকার, আমি কিভাবে বলতে পারতাম তাকে।
পাগল! মনে হচ্ছে আমি চিরদিনের জন্য যাচ্ছি? আর তর দুলাভাই তো বলেছেই সেখানে গিয়ে তকে নেওয়ার একটা ব্যবস্থা করবে। – তার সেই বিষাদের কথাগুলোর প্রতিদত্তরে বলেছিলাম আমি।
-নারে আপু, আমি তোকে হারিয়ে ফেলছি! আমি চাইনা আর তকে ফিরে পেতে!

কি অদ্ভুত দার্শনিক কথাগুলো ছিল আমার ভাইটার।কি অসহ্য ছিল কথাগুলো! আমি আজও সে মুহূর্তের অনুভূতিকে চোখের পানিতে শোধ দিতে পারিনি।

না, এর পর আর দেশে যাওয়া হয়নি। যাচ্ছি যাচ্ছি করে যাওয়া হল না! আসলে যাওয়াটা আমার কাছে নয়! আমার স্বামীদের তেমন কোন আত্বীয় নেই
যে সে টানে দেশে যাবেন। এখন যাওয়া বলতে আমার বাবা মা ভাই বোনদের দেখতে যাওয়া। তাই, দেশে যাওয়ার জন্য মনটা চট পট করলেও মুখ দিয়ে ওকে বলতে পারি নি দেশে বাবা মা, ভাই বোনদের দেখতে যেতে চাই। আমি অপেক্ষা করছিলাম ও’ নিজ থেকে বলুক।
আমি শুধু কল্পনা করে যাই, আমাদের সেই সব দিনগুলোর কথা।
‘আপু, টাকা দে’। এল আর বি’র নতুন এলবাম এসেছে!’ আসলে ও এল আর বি’র গান এতো শুনতে যে তার সাথে সাথে আমি এক সময় এল আর বি’র গানের ভক্ত হয়ে গেলাম! তাই আমরা দুজন শেয়ার কিরে ক্যাসেট কিনতাম। ও’কি এখনো শুনে এল আর বি’র গান- ‘এখন অনেক রাত’ কিংবা ‘অসুস্থ আমি এক হাসপাতালে’।
আমার চোখের পানি গড়িয়ে পরে। কি যে এক প্রশান্তি। সত্যি আমার খারাপ লাগে না। মাজে মাজে ও’ আমার গালের পাশে চোখের পানি দেখ ঘাবড়ে যায়!
-প্লিজ, তুমি মনোবল হারিয়ে ফেলনা। তোমার এই অসুখটা থেকে ভাল হতে যত না শারীরিক শক্তির প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন মানসিক বল। ডাক্তারও তো সেই কথা বলেছে!
আমি হাসি! কি বলব। আমার চোখ দিয়ে কেন পানি আসে সেটা কি ও’কে বুজানো যাবে!
আমি ও’কে আমার পাশে এসে বসতে বলি!
-কি? তোমার ইচ্ছা হয়না?
-কি ইচ্ছে হয়না!
-আমাকে আদর করতে, ভালোবাসাবাসি করতে?
ও’আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
আমি তার সে তাকানোটাকে উপভোগ করি।
বেশি রাত হয়ে গেলে ও হাসপাতালে থেকে যায়। আমরা সারারাত গল্প করি! ও’র মোবাইলে স্টোর করা আমাদের বিয়ের পর থেকে তোলা সকল ছবি একটি একটি করে দেখি।
আমরা প্লান করি বাচ্চাটা আরেকটু বড় হয়ে গেলেই এবার দেশে যাব। কি কি কেনা কাটা করতে হবে তার একটা রাফ করি।
আসলে এরকম রাত খুব কম আসে যখন আমরা আমাদের প্ল্যান শেষ করতে পারি! আমি ক্লান্তিতে নেতিয়ে পরি কিংবা শরীরের সাথে লাগানো মেশিন বিপ বিপ করে উঠে! আমার সামনে বসা কিংবা আমার মাথার কাছে বসা মানুষটি ঝাপসা হয়ে আসে! ঝাপসা হয়ে আসে আমার চারপাশ! দেয়ালের পেন্টিং,পর্দা। তখন একটাই কথা মনে হয়- কেবল মনে হয় এই ঝাপসা হয়ে আসাটাই স্থায়ী হবে চির অন্ধকার হিসেবে। আমি যেন তখন ‘অন্ধকার থেকে অন্তহীন আধার খুঁজি!’

সানডে (ছোট গল্প)

সানডে ~~ সৈ য় দ কা ম রা ন আ হ মে দ
———+++++———-
সাধারণত সানডেতে আমার ছুটি থাকে। মাজে মধ্যে ওয়েদার খুব খারাপ থাকার কারণে স্টাফ কেউ আসতে না পারলে ভোরে উঠতে হয়, এ ছাড়া রবিবার শুধুই আমার! আয়েশ করে সারাটা বিছানায় হাত পা ছেড়ে সকালের কয়েক ঘণ্টা আয়েস করে ঘুমাতে পারি। যদিও কথাটা অর্ধ সত্য! আমার স্ত্রীও সেখানে ভাগ বসিয়েছিল। কিন্তু আমার ভালোবাসার অত্যাচারে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তার ভাগ আর দাবী ছেড়ে দিয়েছে! প্রথম ভাবলাম ঈশ, বেচারা একটু ‘উম’ চাচ্ছিল! আবার পরে ডাবল খাটে নিজের সাহেবি আয়েশের কাছে সেই বোধটাও দেখলাম উদাও। মানুষ মাত্রই আমরা কম বেশি স্বার্থপর।
এছাড়া বাচ্চারাও এখন বড় হয়েছে, বেডে থেকেই ভাই বোন দুটি কথা কাটাকাটি শুরু করে দেয়। বাধ্য হয়েই তাদের মাকে উঠে তাদের থামিয়ে দাঁত ব্রাশের জন্য তাড়া দিতে হয়।
এর পর টেলিভিশন অন’এর শব্দ পাই। তার পর অনেক শব্দ, নাস্তা কি খাবে তা নিয়ে মান অভিমান, এক সময় বাচ্চাদের মধ্যকার কথা বার্তার, ওদের শাসন করার কথাবার্তার  আওয়াজ কমে আসে। আমার কানে আর আসে না। ও’ দরজা এসে ভালো করে বেজিয়ে দিয়ে যায়  যাতে আমার ঘুমাতে অসুবিধা না হয়! হায়, মেয়েদের মন। আবার আমার স্ত্রীই নাস্তা খাওয়ার টেবিলে আমাকে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমাবার জন্য কথা শোনায়!
কখনো ছোট ছেলেটি দরজা ফাঁক করে দেখে যায় আমার ঘুম ভেঙ্গেছে কিনা, যদি দেখে আমি ফোন নিয়ে বিছানায়, তখন ঝাপ দিয়ে উপরে পরে! আর না হয় ফিরে যায়। এটা এজন্য না যে আমি বিরক্ত হই তার জন্য ওরা আসে না, বরং ওদের মায়ের নিষেধের কারণেই আসে না। বাবা ঘুমে থাকলে ডিস্টার্ব করা যাবে না। আহা! মেয়ে মানুষটাকে কে বুজাবে, বাবা হিসেবে তাদের ভোর বেলার শরীরের গন্ধ আমাকে কতটা আলোড়িত করে। বেঁচে থাকাটাকে আবশ্যিক করে দেয়। কিন্তু আমি আমার এসব অনুভূতি প্রকাশ করি না। ও’ আমার প্রতি যে ভালোবাসা দেখায়, আমার সকাল বেলার অতিরিক্ত সময় বিছানায় থাকাটাকে এত গুরুত্ব দেয়, সেটা ভেবেও আমি কম আলোড়িত হই না। ছোট ছোট অনেক ভালোবাসাই ও’ এভাবেই প্রকাশ করে, অথচ ও আমাকে সেটা বুজতে দেয় না।
কিন্তু আজকের সকালটা একটু ব্যতিক্রম মনে হল, ও’র চড়া গলা, কিচেনে শব্দ হচ্ছে উচ্চ মাত্রায়। সাধারণত এরকম হয় না, সানডে তে তো অবশ্যই না। তার মানে কিছু একটা হয়েছে। তবে আমার পক্ষ থেকে যে নয় সেটি নিশ্চিত হয়েই আমি মোবাইলের নোটিফিকেশন গুলো দেখতে লাগলাম! আমি সাধারণত মোবাইল শনিবার রাত্রে ঘুমানোর আগে চার্জে দিয়ে সাইলেন্ট করে রাখি।
তিনটি মিসকল, আননোন নাম্বার। কে হতে পারে ভাবতে গিয়েও আর ভাবলাম না। জরুরী কোন কল হলে আবার আসবে, অসুবিধা নেই। আর কাজের থেকে হলে অবশ্যই নাম্বার উঠত।
নাস্তার টেবিলে গিয়ে দেখি চা টোষ্ট আর ডিম পোঁচ বানানো! তবে শুধু আমার জন্য।
-কি, তুমি নাস্তা করে ফেলছ? জিজ্ঞেস করলাম আমি।
– কেন? তোমার সাথে প্রতি সানডেতে নাস্তা করতে হবে এমন কোন আইন আছে নাকি?
ও’র তির্যক উত্তরে ধরে নিলাম গভীর কোন প্যাঁচ লেগেছে। আস্তে ধীরে, সময় নিয়ে খুলতে হবে। তাড়াহুড়া করা যাবে না, শেষে এমন গিট্টু লাগবে, সারা সপ্তাহ আমাকে বিছানায় একাই ঘুমাতে হবে। নিজের মনেই একটা প্রস্তুতি নিলাম।
-না, তা না, তাছাড়া আসলে আমি এত বেলা করে উঠি, তুমিই বা কেন নাস্তা না করে আমার জন্য অপেক্ষা করবে? তুমি নাস্তা করে ফেলছ, বেশ করেছ। আমিই গতরাত্রে তোমাকে বলব ভাবছিলাম’ আমতা আমতা করে বললাম আমি।
-আমি নাস্তা করে ফেলছি সেটা তোমাকে কে বলল? ও’র নিরস জবাব।
– তার মানে কর নি?  কোন নফল রোজা রাখার দিন নাকি আজ? ঈশ আমাকে বলতে, আমিও রাখতাম। আমার স্বাভাবিক প্রতি উত্তর।
– থাক আমার নাস্তা খাওয়া নিয়ে তোমাকে আর এত চিন্তিত হতে হবে না, তোমারটা শেষ কর, করে শপিং এ যাও! বলল লোবনা।
-শপিং এ! কেন? কাল রাতে না বললে আজকে শপিং এ যেতে হবে না।
-হ্যাঁ, সেটা বলেছিলাম আমাদের জন্য লাগবে না, কিন্তু তোমার পুরাতন প্রেমিকার জন্য তো আর আমাদের গুলো দিয়ে চলবে না?
– পুরাতন প্রেমিকা? সে আবার কে? প্রেমিকা বলতে তো তুমিই, তুমি আবার পুরাতন হলে কবে?
-ঢং কর না, মোহনা’রা আসছে, তোমার মোবাইল এ নাকি ফোন দিয়েছিল, পায় নি? সকালে ঘরে ফোন দিয়ে বলছে, ‘ভাবী আমরা আসছি বিকেলে, ভাইয়াকে বল ঘরে থাকতে’।
-দিয়েছিল হয়ত, মিসকল দেখেছি এই একটু আগে। কিন্তু অপরিচিত নাম্বার তাই আর গুরুত্ব দেইনি।
মোহনারা ইংল্যান্ড এসেছে বেড়াতে! ও’ সম্পর্কে আমার মামাত বোন, বছর সাতেক ছোট, ও’র সাথে আমার বিয়ে হওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল, পারিবারিক ভাবে সেটা ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু আমার তেমন একটা মত ছিল না, প্রথমত বয়সে সে আমার বেশ ছোট, তাছাড়া ও’ বড় হয়েছে আমেরিকায়, মামার ব্যবসায় কিছু সমস্যা থাকার কারণে মামী সহ তাদের ভাই বোন দুটিকে দেশে পাঠিয়ে দেন। বছর খানেক থেকে আবার তারা চলে যায়। আপন জন বলতে দেশে আমরাই ছিলাম ওদের, শহরে বাসা বাড়া নিলেও অধিকাংশ সময় ওরা আমাদের বাড়িতেই থেকেছে। ভালই কেটেছিল আমাদের পরিবার দুটোর সময়। আমেরিকা ফিরে যাবার মাস দুই আগে মামী-ই মায়ের কাছে প্রস্তাব দিয়ে ছিলেন। মামার সাথেও নিশ্চয়ই আলাপ করে নিয়ে ছিলেন। আমাদের পরিবার থেকেও আপত্তি ছিলনা।
কিন্তু আমার যে কি হল, যে মেয়েটি ছোট ভাইয়া ছোট ভাইয়া বলে আমাকে ডাকে তাকে স্ত্রী হিসেবে দেখতে আমার কেমন যেন সংকোচ হচ্ছিল। আমি নিজের মধ্যে থেকে সাড়া পাচ্ছিলাম না। এ ছাড়া সে সময় সামনে ছিল আমার অনার্সের ফাইনাল পরীক্ষা। তাই নিজেকে আর বেশি চাপ দিতে পারিনি সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার।
তবে আমার একটা সন্দেহ ছিল, মোহনা নিজেই হয়ত আমাকে বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করে ছিল। তাই মামীরা চলে যাবার  প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখনই প্রস্তাবটি দিয়ে দিলেন। এর আগে আমাদের দুই ফেমেলির মধ্যে এ রকম কোন কথা উঠেছে, এরকম আমি অন্তত শুনি নি।
মোহনা’রা আমেরিকায় চলে যায়, মাস কয়েক পর তার বিয়েও হয়ে যায় সেখানে। এর পর মামা মামী দেশে এসেছেন, আমাদের বাড়িতে থেকেছেন, কিন্তু আমার প্রতি বা আমাদের প্রতি এমন কোন আচরণ দেখাননি যাতে বুজতে পারতাম যে, মোহনাকে বিয়ে না করায় তারা অপমানিত বা দু:খ পেয়েছেন। খুবই স্বাভাবিক ছিলেন মামা মামী। এতে আমি প্রায় নিশ্চিত হই যে, আমাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত মোহনার একার ছিল, মামা মামী স্বেচ্ছায় বিয়ের প্রস্তাব করেন নি।
তারপর প্রায় ১২ বছর কেটে গেছে। আমি চলে এলাম ইংল্যান্ডে, বিয়ে সংসার ব্যবসাপাতি নিয়ে আস্তানা বানালাম এখানে। মাজে মধ্যে মামা মামীর সাথে কথা হয়, তারা ফোন করেন, আমিও করি, কিন্তু কখনো মোহনার সাথে কথা হয় নি। তবে শুনেছি তারও দুটি বাচ্চা। আমার প্রথম মেয়েটির জন্মের খবর দিতে গিয়েই জানলাম মোহনার এক ছেলে হয়েছে মাস ছ’ আগে।
আমার স্ত্রী মানে লোবনা’র সাথে বিয়ের পর ও’ হয়ত জেনেছে মোহনাদের আমাদের বাড়িতে যাওয়া আসা, থাকা এবং খুব সম্ভবত মোহনার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার একটা সম্ভাবনার। সেটি সে গেঁথে রেখেছে,। এবং আমি যখন মামা মামীর সাথে কথা বলি, প্রথম দিকে সে তখন সেখান থেকে উঠে চলে যেত, কিন্তু আমার বুজতে পারতাম পাশের রুম থেকে সে আমাদের কথা বার্তা শোনে। আমি মোহনার ব্যাপারে কোন কিছু জিজ্ঞেস করি কিনা, বা মোহনার প্রতি আমার ঐরকম কোন আগ্রহ আছে কিনা, সম্ভবত সেটাই যাচাই করার জন্য। একসময় দেখেছি ও’ আর সেটা করে না, পাশেই বসে থাকে, মামা মামীর সাথে কথা নিজ থেকেই বলে।
কিন্তু আজ ও’ এরকম আচরণ করছে কেন? আমি পরিবেশটা হালকা করার জন্য ছেলে মেয়েদের সাথে গিয়ে বসি, নতুন কি খেলা তারা শিখেছে, সেটা নিয়েই আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু আমার কান কিচেনে, লোবনার পায়ের সাথে। ও’ কি করছে, কি ভাবছে, কিছু বলছে কিনা, তার দিকেই আমার মনোযোগ। নিজেকে ছেলে মেয়ে দুটির সাথে যতই ব্যস্ত রাখি, ভেতরে আমার খচ খচানি যাচ্ছিল না।
মোহনা’রা যদি আসেই আর লোবনা যদি এরকম আচরণ করে, তবে লজ্জা আমার না যত, তার চেয়ে লোবনা’রই বেশি। আর আমি সেটা ঠিক মেনে নিতেও পারব না। তাছাড়া লোবনা নিশ্চয়ই তার স্বামীকে নিয়েই আসছে যখন বলেছে আমরা আসছি!
আমি বুজলাম লোবনা কিচেন থেকে বেডরুমের দিকে যেতে। আমি কি যাব? তাকে জিজ্ঞেস করব সে কেন এমন আচরণ করছে? সরাসরি কি জিজ্ঞেস করব ও’কি চায় না লোবনারা আমাদের বাসায় আসুক? আর এও শোনা উচিত ও’ কেন লোবনাকে আমার পুরাতন প্রেমিকা ভাবছে?
কিন্তু সেটা কি ঠিক হবে? লোবনা তো এরকম রিয়েক্ট করার মত মেয়ে না। যে মেয়েটি আমার ভালোবাসার সূত্র, আমাকে দুটি সন্তানের গর্বিত বাবা হবার সুযোগ দিয়েছে, তার স্বামীর অতীত নিয়ে এত বিচলিত হওয়ার কথা না। কি করা যায়?
আমি মোবাইল ফোন আনার ছলে বেডরুমে ঢুকলাম। তাকে রুমে না দেখে ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। পরক্ষণেই বাথরুমের লাইট অন দেখে কিছুটা স্বস্থি পেলাম।
লোবনা এরকমই, মন খারাপ হলে, কিংবা আমার কোন কথায় ও আহত হলে কিছু বলবে না, বাথরুমে ডুকে গিয়ে অনেক অনেক সময় নেয়। জিজ্ঞেস করতাম, তুমি বাথরুমে ডুকে কেন এত সময় নাও, তোমার একা থাকার ইচ্ছে হলে সেটিং রুমে কিংবা বেডরুমে গিয়ে বসে থাকতে পার। কোন উত্তর দেয়নি সে, শুধু এমনভাবে তাকিয়ে ছিল যে, ও’কে আর কোন দিন জিজ্ঞেস করার সাহস হয় নি। সেই তাকানোতে আমি ঠিক ভয় নয়, অন্য কিছু, অনেক গভীর কিছু, আমি দেখেছি যাতে এমন কিছু ভাষা ছিল, যা স্বামী হিসেবে আমি আজও বুজে উঠতে পারি নি। এ আমার ব্যর্থতাও বলা যায়।
আমি অপেক্ষায় থাকি, একটা দুদিল্যমনায় আটকে থাকি। লোবনা যদি এরকম আচরণ তাদের সামনেও করে তখন মোহনা না হোক, ও’র স্বামীর কাছে আমার পুরুষ হিসেবে মাথা তুলাই দায় হবে!
নাকি ওদের বলে দিব, আমি বাসায় থাকব না, জরুরী একটা কাজে একটা জায়গায় যেতে হবে। যদিও সানডেতে জরুরী কাজের বাহানা তেমন জোরালো নয়, তবুও সামনা সামনি অপ্রত্যাশিত কোন আচরণের মুখোমুখি হওয়ার সাহস পাচ্ছিলাম না।
বাথরুমে টেপের পানির শব্দ পেলাম, তার মানে একটা আশা হচ্ছে লোবনা বের হবে, যাক যদি কিছুটা……
আমি বেডরুমে এসে বসে থাকি। এর অনেক্ষন পর ও’ বের হয়ে আসল। আমি তার দিকে তাকাব কি তাকাব না সেটা ভাবতে গিয়েই ও’র মুখের দিকে চোখ গেল।
লোবনার চিবুক আর চোখ বলছে ও’ কেঁদেছে? নি:শব্দে। আমাকে, আমাদের কাউকেই শুনতে দেয় নি সে তার কান্না। এই মেয়েটিকে মাজে মধ্যে মনে হয় আমি চিনি না। অনেক অচেনা এক কিশোরীর ছায়ার মত। দুটি সন্তানের মা হয়েও নিজেকে গুটিয়ে রাখতে, নিজেকে নিজের শৈল্পিক সত্ত্বার মধ্যে এখনো সে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। আমার এও মনে হয়, এক দিক থেকে ভালই। যদি কোন দিন হঠাৎ আমি না ফেরার দেশে চলে যাই, নিজেকে সে ঠিকই সামলাতে পারবে। আমার খুব মায়া হয় ও’র জন্য।
কিছুক্ষণ পর দেখি মোবাইলে ম্যাসেজ। ‘সরি’ তার পর কি কি শপিং লাগবে তার একটা লিস্ট। আমি তার দিকে তাকালাম। ও আমার দিকে পিছন দিয়ে নিজের চুল নিয়ে ব্যস্ত।
আমি উঠে গিয়ে তার সামনে বসলাম। তার হাত দুটি নিয়ে তাকালাম তার চোখের দিকে। কিন্তু কোন শব্দই আসছে না মুখে।
তার আঙ্গুল গুলো আমার মুঠোতে নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
সে চোখ নামিয়ে নেয়, মুখটাও। আমি তার মুখ দেখতে পাচ্ছিনা।
হঠাৎ উপলব্ধি করলাম আমার মুঠোর মধ্যে ও’র আঙ্গুল গুলো সজীব হয়ে উঠছে এবং এক সময় বুজলাম প্রচণ্ড শক্ত করে ও’ আমার হাতটাকে ধরতে চাচ্ছে। লোবনা কাঁদছে।
আমি কি বলব বুজতে পারছিনা। অথচ আমার কিছু বলা খুবই জরুরী।
আমার অক্ষম শব্দ গুলোকে ডিঙ্গিয়ে ও’র কাঁপাকাঁপা শব্দের টাইটানিক ভেসে উঠল যেন আবার।
– ক্ষমা করে দিও প্লিজ, তোমার সাথে ঐ রকম আচরণ করা ঠিক হয় নি।
-ধ্যাত, এখানে ক্ষমা চাওয়ার কি, আগে বল তুমি কাঁদছ কেন? আমার কোন কথায় কি তুমি কষ্ট পেয়েছ। পেয়ে থাকলে আমিই তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থী।
ও’আমার দিকে সেই একই চোখের ভাষায় তাকাল, যে চোখের ভাষা পড়তে আমি জানি না।
নিজেকে এত অসহায় লাগছিল, আমি হাত ছেড়ে ও’র মুখটা নিজের দিকে তুললাম। আমি ও’র চোখের পানি আঙ্গুল দিয়ে মুছে দিয়ে বললাম, আমাকে যদি তোমার এই অশ্রুই দেখতে হয় তাহলে এই পরিবার জীবন অর্থহীন, আমি একজন অপদার্থ স্বামী। শুধু একবার বল আমি কি তাই?
ও’ যেন কেঁপে উঠল।
-তুমি নও, আমি! ও কাঁপছে।
-কি বলছ তুমি’ আমি ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
হ্যাঁ, আমি জানি, তোমার মামাতো বোনের প্রতি তোমার ইমুশ্যনাল কোন দুর্বলতা নেই। কিন্তু ও’র তো আছে! আর আমি যে মানুষটাকে এত ভালোবাসি, যে মানুষটাকে আমি ভাবি শুধু আমার, সে মানুষটার প্রতি অন্য আরেকজন একই ভালোবাসার দৃষ্টিতে থাকাবে, কথা বলবে, সেটা আমি কিভাবে সহ্য করব বল, তাও আবার চোখের সামনে। লোবনা নিজের মুখটা নিজের হাত দিয়ে ঢেকে নেয়।
আজ এত বছর পর, হঠাৎ নিজের প্রতি করুণা হল। তুমি এত অযোগ্যই স্বামী! নিজের স্ত্রীর চোখের গভীর নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ ভালোবাসাকে পড়তে পারনি।
ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠে। ও’কে কি আমার এখন জড়িয়ে ধরা উচিত নাটকের সিনের মত। নাকি ইংলিশ ছবির মত চুমু খাব?
কিন্তু ও’র প্রতি কি আমার ভালোবাসার কোন খাদ আছে? না, নেই। তাই ও’ আমাকে এতটা আপন করে নিয়েছে, মনের এমন এক জায়গায় স্থান দিয়েছে যেখানে অন্য কারও ছায়াও সহ্য করতে পারছে না।
না, সেরকম কোন সিন ক্রিয়েট না করলেও চলবে, বরং আমি আমার মতই ও’র হাত দুটো নিজের হাতে তুলে নিলাম আবার।
চোখ মুছ, একটু গম্ভীর হয়েই বললাম।
তাকাও আমার দিকে। আমি জানি তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো। কিন্তু এত ভালোবাসা কি ভাল?
ও’ আমার কথা যেন বুজতে পারছে না, সেভাবে তাকাল।
আমি তার সেই চাহনি কে বেশ উপভোগ করলাম।
তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম দেখ-
মোহনা আসছে, এটা আমাকে কিছুটা অবাক করলেও আসলে ব্যাপারটা কি সে রকম।
ও’ তো এসেছে ও’দের চাচার বাসায়, তাও সামার ভেকেসন কাটাতে বাচ্চাদের নিয়ে। এখন তুমিই চিন্তা করে দেখ- সেই আমেরিকা থেকে এসেছে, স্বাভাবিক ভাবেই সে তার আত্মীয় স্বজনদের বাসায় যাবে, এটাই তো স্বাভাবিক। আমরা কি তার আত্মীয় নই। আর এত বছর পর ইমুশ্যনাল কোন ব্যাপার থাকার কি কথা, যেখানে তার নিজের স্বামী সন্তান সংসার আছে?
আমি থামি।
ও’ কোন কিছু না বলে ‘হুম’ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
আমি তাকের একটু একা থাকার সুযোগ দিয়ে উঠলাম।
তাড়াতাড়ি এস, আমি তোমার জন্য চা আর নাস্তা করছি, বলে আমি কিচেনের দিকে চলে গেলাম।
একটু পর ও’ কিচেনে এসে স্টুলে বসল।
-এখন থেকে প্রতি সানডেতে তুমি আমার জন্য চা নাস্তা বানাবে। বলব লোবনা।
-মানে? এটা কি নতুন কোন আইন? আমার বিস্মিত প্রশ্ন।
-হ্যাঁ, নতুন আইন, আজকে থেকে কার্যকর।
-তাহলে আমার ঘুম?
– হুম, ঘুমই ঠিকই থাকবে, তবে যখন উঠবে তখন দিবে। বলল লোবনা।
-ততক্ষণ তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে! আমি জিজ্ঞেস করি।
-না!
-তবে যে বললে তোমাকে চা নাস্তা বানিয়ে খাওয়াতে!
-হ্যাঁ, সেটাও ঠিক আছে।
-কিভাবে?
কারণ আমি জানি, তোমার পক্ষে আমাকে অপেক্ষায় রাখা সম্ভব হবে না! তুমি ঠিক ঠিকই আমার সাথে কিংবা একটু পর উঠে যাবে’ বলে ও এমনভাবে হাসল, ঠিক ভেতরটায় গিয়ে বাজল!
আমি সুযোগটা ছাড়লাম না।
আচ্ছা এক কাজ করলে কেমন হয়, ধর, তুমিও আমার সাথে ঘুমিয়ে থাকলে অনেক বেলা পর্যন্ত, যেমনটি আগে থাকতে!
আমার কথার ইংগিত বুঝতে পেরে, ও অস্পষ্টভাবে কিছু বলল, বুজতে পারি নি, তবে রাজি হল, শর্ত একটা, বাচ্চারা যতক্ষণ তাদের বিছানায় থাকবে ততক্ষণ!
হুম মন্দ হয় না, ফুল না পাই, ফুলের সুভাস তো পাব! আমি তার নাকটা টিপে বললাম।

পুনশ্চ: মোহনা’রা বিকেলে না এসে এসেছিল রাতে। অবশ্য সেটা ওরা ফোন করে বলেছিল।
লোবনাও যেন খুশি হল তাতে, ঘর দোর কিছুটা গোছ গাছ করে নিল। অনেকগুলো আইটেম রান্না করেছিল যা সময় হাতে থাকায় সম্ভব হয়ে ছিল। যেটি অবাক করেছিল আমাকে, তা হচ্ছে মোহনার সাথে লোবনার অসংকোচ আলাপ গল্প। তারা দু’জন গল্প করছিল কিচেনে আর আমরা মানে মোহনার স্বামী আর আমি সেটিং রুমে বসে দেশ বিদেশ, খালেদা হাসিনা, বুশ ব্লেয়ারের গোষ্টী উদ্ধার করছিলাম। বাচ্চারা খেলছিল তাদের রুমে।
শোবার সময় জিজ্ঞেস করলাম- কি বুজলে আমার পুরাতন প্রেমিকাকে? এখনো আমাকে স্বামী হিসেবে পেতে চায়?
লোবনা চিমটিয়ে দিয়েছিল আমার সারা শরীর!

একটি নীল শার্ট ও তার গল্প ~সৈ য় দ কা ম রা ন আ হ মে দ

এখন দুপুর। মাথার উপর দাড়িয়ে আছে যেন এক অগ্নি দৈত্য। মাথাটার চুল গুলো পুড়ানোই যেন শুধু বাকী! শালার! ক্যাপটাও আজ আনা হয়নি। কলেজ থেকে বের হয়েছে আধ ঘন্টা আগে।  রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে করতে শেষ পর্যন্ত এই মাথা পুড়ানো রোদের মধ্যে হাটা শুরু করে রুমান। মেয়ে হলে ভাল হত। ওরা আবার চট্ করে রিকশাও পেয়ে যায়। ওইতো, একটু আগে একটা খালি রিকশাকে যেতে দেখে ডাকল, কিন্তু বলল যাবেনা। কিন্তু রুমান দেখল কিছু দুর গিয়ে দুটি মেয়ের ডাকে থামল, মেয়ে দুটিকে তুলল। শালা! মেয়ে দেখে ভাব ধর, না? যেন মেয়েদের জন্যই রিকশা, ছেলেদের কে ঠেকায় পরে তুলে। কিন্তু এখন উপায়। রুমান সিদ্ধান্ত নেয়, পরিচিত কাউকে রিকশায় দেখলে টুপ করে উঠে পরবে, নো ফরমালিটি। যদিও এ ব্যাপারটা সব সময় সে এড়িয়ে চলে।
-রূমান ভাই!
পেছন দিক থেকে ডাক শুনতে পায়, ঘুরে তাকায় সে। একটি বোরকা পড়া মেয়ে। একটুতো অবাক হয়ই। এক, মুখ না দেখার কারনে চিনতে পারছে না, দুই,কলেজের পরিচিত কেউ বলেও মনে হচ্ছে না। নিজ স্থানে দাড়িয়ে থাকে সে। কাছে আসুক, দেখা যাক চেনা যায় কিনা।
-‘আপনাকে আজ এক সপ্তাহ ধরে খুঁজছি। বাড়িতেও পাইনা, কলেজেও না, থাকুন কোথায় বলুনতো?’
কন্ঠস্বর জানাশোনা কারোর মত লাগছে, যাক্ অপরিচিত কেউনা তাহলে! তারপরও নিশ্চিত হওয়া দরকার।
‘আপনাকে ঠিক……’
ফিক্ করে হেসে ফেলে মেয়েটি। রুমান কিছুটা ধাঁধায় পড়ে। রুমানের মুখ দেখে কিছু বুঝতে পারে মেয়েটি, মুখের নেকাব খুলে।
-ও, তুই!
-চিনতে পারছেন তাহলে?
-হ্যাঁ, কিন্তু বোরকা…..
সীমা। রুমানদের দুইটি বাসার পর ওদের বাসা। একই এলাকায় থাকে তার উপর লতায় পাতায় চাচাত ভাই বোন সম্পর্ক। আরেকটা সম্পর্ক অবশ্য আছে। ছাত্রী শিক্ষক সম্পর্ক। সীমার এইচ,এস,সি পরীক্ষার সময় মাস তিনেক পড়িয়ে ছিল। চাচী এমন ভাবে বললেন যে, না করতে পারেনি।
‘ইংরেজিতে এমনেইরেবা কাচাঁ, তার উপরে আরো ফার্স্টডিয়ারো জিতা পড়ছিল, তার সব খাইয়া বই রইছে!’
আর সীমাই নাকি আগ্রহ নিয়ে বলেছিল ‘রুমান ভাইর যে মাথা, দু মাস পড়াইলেই লেটার মার্কস’!
পাম্প দেয়া আর কি!  রুমান বুজে। মেয়েকে পড়ানোর জন্যই একটু ইয়ে দিলেন!
– কিন্তু তোকে চিনবার তো কোন উপায় রাখলি না, আমি আবার ভাবছিলাম কে না কে! বোরখা নিলি কবে?
– নিয়েছি, এই তো সপ্তাহ দুই হল।
-কিন্তু হঠাৎ?
-নিলাম, আর আপনিওতো চান।
-আমি  চাই মানে?
-কেন ঐ যে সেদিন বিয়ের অনুষ্ঠানে…..
-ও! তা বোরখা নেয়ার কথা তো বলিনি, বললাম আরেকটু… অসমাপ্ত রাখে রোমান।
-ওই একই; – সীমার নিস্প্রভ জবাব।
রুমান কে খুশি করার জন্য কিংবা তার কথার উপর জিদ করে যে সীমা বোরকা নিয়েছে, সে  বুঝতে পারে। এই বয়সে এসে এমনই হয়!
– আচ্ছা বল, খুঁজছিস কেন? তোর কথায় তো ইমার্জেন্সির গন্ধ পাচ্ছি।
– বলব, কিন্তু এখানে? যা গরম পড়ছে, দেখুন না ঘেমে গেছি একেবারে।
হেসে ফেলে রুমান।
-দেখব কি করে? তোর তো টপ টু  বটম ঢাকা।
– তাও ঠিক, সীমাও হাসল এবার।
হাসলে এই মেয়েটাকে কেন যে এত ভাল লাগে! নাকি সব মেয়েকেই হাসলে সুন্দর দেখায়?
-অবশ্য তোর নাকটা দেখা যাচ্ছে; বিন্দু বিন্দু শিশির..
-রুমান ভাই! আপনি মাজে মধ্যে এমন সব কথা বলেন না; রাগ হয়।
-আচ্ছা! তোর আবার রাগ আছে নাকি, জানতাম না তো?
– আবার?
– ওকে, মাফ চাচ্ছি। কিন্তু এখন একটা সত্য কথা বলি।
-কি?
– রাগ করবি না বল?
– হু!
-‘তোকে কিন্তু খুভই সুন্দর লাগছে, লালচে গাল আর নাকে তোকে অন্য রকম লাগছে। অবশ্য তুই এমনিই সুন্দর’।
কোন উত্তর আসে না সীমার দিক থেকে। ভুল হয়ে গেল। আসলে ও ফর্সা না, শ্যামলা। কেউ তাকে সুন্দর বললে ও খুশি হয়না, ব্যাপারটা সে অন্যভাবে দেখে। সীমা ব্যাপারটা বলেছিল একদিন রুমানকে। কিন্তু রুমান জানে সীমার মাজে একটা আলাদা সুন্দর্য্য আছে, যা বলার নয়, সে কোনদিনই তা পারবেনা সীমাকে বলতে। থাক্, এটা তার কাছে তার নিজস্ব ‘সৌন্দর্য্য’ হয়েই থাক।
-আচ্ছা, বুজলাম, কিন্তু আমাকে খোঁজার কারনটাতো এখানেই শুনতে পারি। রোমান প্রসংগ ঘোরায়।
-পারেন, তবে…
ইত্বস্ত করে সীমা তার পর বলে
– আচ্ছা চলুন কোথাও গিয়ে বসি।
-কোথায় বসবি, এদিকেতো বসার ভাল কোন ব্যবস্থা নেই।
-চলুন না শাকুরায় যাই।
-শাকুরায়! এই রুদ্রের মধ্যে হেটে ঐ দিকে যাবি!
যদিও সেটা খুভ বেশি দুর নয় কিন্তু রুম্মান চাচ্ছে না কলেজের আশে পাশে রীমাকে নিয়ে বসতে।
-আমার কোন সমস্যা হবেনা সীমা উত্তর দেয়।
-তা না হয় হলনা, কিন্তু খুঁজছিস কেন সেটাতো বললি না।
-কারন তো আছেই, আর কারন ছাড়া কি কেউ কাউকে খুঁজতে পারেনা? লাইব্রেরীতে যাব, আমাদের ক্লাস শুরু হবে শ্রীগ্রই, বই কিনতে হবে।
-তা তো তুই নিজেই কিনতে পারিস।
-পারি, আপনি থাকলে ভাল হয়। আপনি যাবেন কিনা বলুন? কিছুটা রাগ নিয়ে বলে সীমা।
– আরে, রাগ করছিস্ কেন, যাবনা কেন,যাব, কিন্তু..!  আসলে রুমান চাচ্ছিল সীমাকে এড়াতে।
-যাবেন তো আবার কিন্তু কিসের; আপনার সব সময় একটা কিন্তু থাকে।
না, আজ সীমাকে আর এড়াতে পারবেন না রোমান সাহেব! নিজেকেই বলে রোমান।
-আচ্ছা চল। কিন্তু বই কিনতে গিয়ে আজ ঠগবি, এটি আমি আগেই বলে দিলাম, লাইব্রেরীওয়ালারা আজ কমিশন দশের উপর উঠাবে না, চান্দি গরম এখন সবার।
রোমানের কথা শুনে আবার হাসে সীমা।
-সে দেখা যাবে, চলুন।
সীমাই এগিয়ে গিয়ে একটি কোনার দিকে টেবিলে বসে। রোমান সীমাকে অনুসরণ করে।
সিলিংয়ের সাথে বসানো স্পিকারে গান বাজছে.. ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই,আজ আর নেই…’
গানটা শুনতে বেশ লাগে যদিও তার কোন আড্ডা ছিলনা, কিন্তু বসা হয়; প্রায়ই, তবে এই রকম কফি হাউজে না, চা স্টলে। সেখানেও গান বাজে ফেটে যাওয়া স্পিকারে, দোকানের ক্যসিয়ারের পছন্দ মত। সবই প্রায় ‘ফাইট্টা যায়’ টাইপের গান। পুরাতন হিব্দি ছবির গানও বাজে। একবার একটা গান রুমানের খুভ ভালো লেগেছিল-‘একবার দাড়াও বন্ধু এত দিনে পাইছি তোমার লাগ’… কার যেন ছিল গানটা রোমান জানে না।
– কি খাবেন?
– সীমার গলার আওয়াজে তার গান ভাবনায় ছেদ পরে।
– আমার কোন পছন্দ নেই, তুই-ই পছন্দ কর। বলে রোমান।
-জানতাম আপনি এরকম কথা বলবেন।
-তার মানে?
-আপনাকে আমি চিনিত!
-বুজিয়ে বল
-আপনি যখন আমাকে পড়াতেন তখনই লক্ষ করেছি এসব ব্যাপারে আপনি নিরব থাকেন। যেমন দুধ চা নাকি রং চা জিজ্ঞেস করলে আপনি তো এরকমই বলতেন। অনেকদিন আমি আপনার চায়ে ইচ্ছে করেই চিনি কম দিতাম, কখনো কখনো দিতামই না, অথচ আপনি নির্বিকার থাকতেন, যেন চায়ে মিষ্টি হওয়া না হওয়া একই ব্যাপার।
রোমান কিছু বলছে না দেখে জিজ্ঞেস করে সীমা।
-কি রাগ করলেন?
-কেন? রোমান পাল্টা প্রশ্ন করে।
-এই যে আপনার সাথে দুষ্টুমী করেছিলাম বলে।
-নাহ্, আর আমি কার উপর সহজে রাগ করতে পারিনা।
-আমি তাও জানি। বলে একটু হাসল সীমা।
এ হাসির অর্থ কি? ভাবে রুমান।
-কি, আমি যা পছন্দ করব খাবেন তো?
মাথা দুলায় রুমান। কিছুক্ষন নিরবে কাটে দুজনের।
– কিছু বলছেন না যে।
-আমি কি বলব, তুই ই বল, তোকে আজ খুভ খুশি খুশি লাগছে।
– তা কিছুটা অবশ্য বলতে পারেন। কেন সেটা জিজ্ঞেস না করলেও বলছি; আমার খুভ ইচ্ছা ছিল আপনাকে নিয়ে আপনারই কোন প্রিয় চা-স্টলে আপনার সাথে বসে চা খাই। যেহেতু সেটা সম্ভব না, তাই এখানেই আসলাম। জানি, আপনি এখানে আপনার চা-স্টলের মত আনন্দ পাচ্ছেন না, কিন্তু আমি পাচ্ছি, একটু হলেও….. অসমাপ্ত রাখে সীমা, এক সাথে কথাগুলো বলে।
রুমান নিরব থাকে। ব্যাপারটা বুজার চেষ্টা করে। সবকিছু হেয়ালীর মত লাগছে। সীমাকে যতটুকু জানে, ও এরকম আচরন কখনো করেনি। ঘটনাটা কি? সরাসরি জিজ্ঞেস করবে নাকি? আবার যদি অন্যকিছু মনে করে। হু, বড়ই সমস্যা হল তাহলে। নিজের সাথেই কথা বলে রোমান।
-কি, কিছু বলছেন না যে। সীমা জিজ্ঞেস করে আবার।
আবার সেই প্রশ্ন! কি বলবে সে। সে নিজেই আছে দন্ধের মাজে। তারপরও কিছু না বলেতো উপায় নেই।
-তুই কি এখানে প্রায়ই আসিস।
-না, মানে কেন বলুনতো?
-আমার মনে হচ্ছে, এখানে তুই প্রায়ই আসিস এবং এটা তোর প্রিয় একটা জায়গা। উত্তর জানার অপেক্ষায় থাকে রোমান।
কোন উত্তর আসেনা ওপাশ থেকে।
-কি ঠিক বলিনি?
-প্রায় বলতে মাজে মধ্যে আসি, আর প্রিয়? হ্যাঁ, তা কিছুটা বলা যায়, তবে আপনার চা স্টলের মত না। সীমা তাকায় রুমানের দিকে।
কিছুক্ষন নিরবতা তারপর রোমান জিজ্ঞেস করে-
-তারপর পরাশুনার খবর কি? ইংরেজী নিলি শেষ পর্যন্ত?
-হ্যাঁ নিলাম, আগামী সপ্তাহ থেকে ক্লাস শুরু হবে। বলে সীমা।
কিন্তু সীমা ভাবে অন্য বিষয়; রোমান জানল কি করে সে ইংরেজি নিয়েছে, রোমানকে তো সে বলেনি!
– কিন্তু আপনি জানলেন কিভাবে? আপনাকে তো বলিনি। সীমার কথায় তীব্র কৌতুহল।
জবাবে রোমান একটু হাসল যার অর্থ দাড়ায় ‘কিভাবে জানলাম তা না হয় একটু রহস্যই থাক।’
সীমা এবার অনার্স ১ম বর্ষ। ইংরেজি নিল অথচ ইংরেজিতে বরাবরই কাঁচা। রোমান বুঝতে পারে কারনটা। তাইতো উত্তরটা শুধু ‘হ্যাঁ’তেই রেখেছে। রোমান মাঝে মাঝে সীমাকে বুঝতে পারে না, নাকি সব মেয়েই এ বয়সে একটু রহস্যময় থেকে যায়! এইচ,এস,সি তে কোন সাবজেক্ট নিবে তার প্রধান পরামর্শক হিসেবে বেছে নেয় রোমান কে। অথচ ভর্তির সময় রোমানের পরামর্শের বিপরীতটাই সীমা করেছিল। সাইন্সে কাঁচা অথচ সাইন্সই নিল। রোমানের সাইন্স ছিল বলে? কিস্তু রোমানকে অবাক করে এইচ,এস,সি, তে দুই সাবজেক্টে লেটার সহ প্রথম বিভাগে পাশ করে। এর কৃতিত্ব নাকি রোমানের। ঘটনা হচ্ছে এইচ,এস,সি ফাইনাল পরীক্ষার মাস তিনেক আগ থেকে সে সীমাকে পড়িয়েছিল। পড়ানো কিছুই না, সীমার প্রিপারেশন ভাল ছিল। যা সে করেছিল তা হচ্ছে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার আর সীমার যে বিষয়ে বুজতে অস্পষ্টতা ছিল সেটা তাকে সহজে বুজে নিতে সাহায্য করেছিল। এর মধ্যে কোন কৃতিত্ব নেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রায় দিনই  থাকে ইরেজির ‘The Magi’ গল্পটা নিয়ে ঘষামাজা করতে হয়েছিল। কিন্তু মূল ঘটনাটা ছিল ভিন্ন। ঐ বয়সে যা হয়। রোমান কয়েকদিন বেশ উপভোগ করেছিল সীমার পাগলামো। কিন্তু এক সময় রোমান নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। সীমার মাজে ছিল একটা রঙ্গীন ঘোর। কিন্তু রোমানের অবস্থা ছিল ভিন্ন। তাকে প্রতিটা মুহুর্ত বাস্তবতার সাথে হিসেব করে চলতে হয়। ব্যাপারটায় মান সম্মানও জড়িত ছিল দুটি পরিবারের। সীমা তার রঙ্গিন স্বপ্ন নিয়ে ব্যস্থ থাকলেও রোমান বাস্তবতাকে এড়াতে পারে না। তাই সে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। সীমার পরীক্ষার পর সীমাদের বাসায় যাওয়া আসাও প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। কিস্তু রোমানের ভিতর কি একটুও দুর্বলতা ছিলনা সীমার প্রতি? মাজে মাজে রোমান নিজেকেই প্রশ্ন করে। নিজের সাথে কি মিথ্যে বলা যায়? সামান্য ছিল হয়ত। তাইতো রাস্তায় কখনো দেখা হলে রোমান অস্বস্থি বোধ করত। তাই পারত পক্ষে সে সীমার মুখোমুখি হত না। কি দরকার নিজের ভিতর জন্ম নেয়া অতি ক্ষুদ্র দুর্বলতা ওর সামনে প্রকাশ করার। কিছুটা কষ্ট হলেও রোমান ঐ সময়কার মানসিক দন্ধকে সামাল দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু এখন কি হবে? আজকে সীমা এখানে সামনে বসে। যদি অনেকদিন আগেরকার দুর্বলতা কোন অসতর্কভাবে বের হয়ে যায়? সীমাও কি নিজেকে আগলে রাখতে পারবে?
-তারপর? তোর সময় কেমন যাচ্ছে? নিরবতা ভাঙ্গার জন্য প্রশ্ন করে রোমান।
-এইতো যাচ্ছে। ক্লাস শুরু হবে। সীমার ছোট্ট জবাব।
-আচ্ছা, ইংরেজি নিলি কেন? পড়ে সমস্যা হবে নাতো?
– না, হবে না। তাছাড়া…
অসমাপ্ত রাখে সীমা তার কথা।
– তাছাড়া কি?
– না, মানে কোন সমস্যা হলে আপনিতো আছেনই।  রোমান কিছুটা হতচকিয়ে যায়। কিন্তু সামলেও নেয়। মুহুর্তেই বুজে যায় সীমার আসল অভিপ্রায়। না, এবার আর সে সুযোগ সীমাকে দেয়া যাবেনা, আর সেটা সম্ভবও নয়। সময়তো আর সব সময় এক থাকেনা।
-কি, আপনি সাহায্য করবেন না? সীমা জিজ্ঞেস করে। রোমান হ্যাঁ না কিছু বলেনা, শুধু একটু হাসে। তারপর অনেক্ষন নিরবতা। দুজনেরই মাজে কম বেশি দন্ধ।
-আপনি সত্যিই কি চলে যাবেন? সীমার কাপাঁ স্বরে প্রশ্ন।
-কোথায়? রোমানের তড়িৎ পাল্টা জিজ্ঞাসা। যদিও জানে প্রশ্নটা কোন প্রসঙ্গে। কিন্তু সীমার তো…..
-আমাকে লুকোতে চান?
-না, তোকে আবার কি লুকাব?
-তাহলে যে বললেন কোথায়।
ইস, সীমা কি জেনে ফেলেছে। কিন্তু তার এখন তো জানার কথা না‍!
-কি, তাহলে যাচ্ছেন?
কিছুটা আমতা আমতা করে মাথা নাড়ে রোমান।
-আসলে কি, মাত্র কাগজ পত্র জমা দিচ্ছি, দেখি কি হয়। টাকা পয়সারও কিছু সমস্যা আছে।
-তাই বাবার কাছে টাকা ধার চেয়েছেন?
এবার রোমানের আর বুজতে কষ্ট হলনা সীমা কিভাবে তার বিদেশ যাবার কথা জেনেছে। রোমান ইংরেজি অনার্সের ৩য় বর্ষে। ইচ্ছে অনার্সটা কমপ্লিট করা। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও সেটা সম্ভব হচ্ছে না। বাবার হঠাত মৃত্যুর পর পারিবারিক অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। জীবন সম্পর্কে কিছু বুজুক না বুজুক রোমানের এতটুকু বুজতে কষ্ট হয়নি যে পরিবারটিকে সচল রাখতে হলে থাকে এখনি কিছু করতে হবে। রোমানরা দুই ভাই এক বোন, ভাইটি ওর ছোট এবার এইচ এস,সি দিবে আর সবার ছোট বোন ক্লাস নাইনে পড়ছে। সুতরাং বড় ভাই হিসেবে তাদের পরাশুনা চালিয়ে নিতে হলে তাকে এখনই রোজগারে নামতে হবে। কিন্তু এই শহরে তার মত ছেলের একটা ভাল রোজগারের সুযোগ কোথায়? তাই অনেক ভেবে রোমান মালেশিয়া যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু যেতে চাইলেইতো আর যাওয়া যায়না। টাকা পয়সার ব্যাপার। এছাড়া দালালকে অর্ধেক টাকা এখন দেয়া এবং বাকি টাকা মালেশিয়া গিয়ে দিবে এই শর্তে রাজি করিয়েছে। কিন্তু বাকী টাকার জন্য কাউকে তো ‘যাবিন’ নিতে হবে। তাই বাধ্য হয়েই রোমান ইরফান চাচা মানে সীমার বাবাকে ব্যাপারটা বলেছে। সীমার বাবা যেমন মানুষ ভাল তেমনি তিনি রোমানদেরকে সকল প্রকার সাহায্য করে আসছেন বাবার মৃত্যুর পর থেকেই। তিনি রোমানের বিদেশ যাওয়ার জন্য সব ধনের সাহায্য করবেন বলেছেনও। অবশ্য রোমান এর  বিনিময়ে তাদের কিছু ধানি জমি ইরফান চাচার কাছে বন্ধক রাখবে। চাচা প্রথমে জমি বন্ধক নিতে না চইলেও শেষে রাজি হয়েছেন।
‘আজ আমার বিয়ে’- জানেন?
সীমার হঠাৎ কাঁপা স্বরের উচ্চারন। রোমান হতবুদ্ধি হয়ে যায়। বলে কি মেয়ে!
– ধ্যাত, এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলছিস? আর এসব নিয়ে তর আমার সাথে ফাজলামো কি মানাচ্ছে? রোমান বলে।
– ফাজলামো নয়, সত্যি। সীমার নিচু স্বরে জবাব।
-সত্যি বললেই কি আমি বিশ্বাস করব। আর সেরকম কিছু হলে চাচা-চাচী নিশ্চয়ই আমাকে বলতেন। গত দুদিন আগেই তো চাচার সাথে উনার

Continue reading একটি নীল শার্ট ও তার গল্প ~সৈ য় দ কা ম রা ন আ হ মে দ