যে প্রশ্নটি ইদানিং আমার মাথায় তিড়িংবিড়িং করে লাফাচ্ছে সেই প্রশ্নটি হচ্ছে; :আমি কি সত্যিই মানব সভ্যতার শ্রেষ্ট সময়ে বাস করছি?’
আমাদের চারপাশের যা ঘটছে, আমাদের চোখের আড়ালে, দুরে, আমাদের নিত্য দিনের ব্রেকিং নিউজ পুনরায় ভাবতে বাধ্য করে- আমরা কি আসলেই সভ্যতার উৎকর্ষে উপনীত হয়েছি?
আদিম সমাজ বলে আমাদের আজকের তথাকথিত সভ্য সমাজ নাক সিটকালেও আদিমতাই বর্তমান সমাজের আষ্টে পৃষ্টে জড়িয়ে আছে। হয়ত মোড়াক কিছুটা জমকালো, বাহ্যিক প্রকাশ পৃথক কিন্তু মৌলিক যে বৈশিষ্ট্য, তাতে আমি সামন্যই পার্থক্য দেখতে পাই।
আদিম সমাজের মানব সভ্যতার কথা যদি বাদই দেই, এই যে আমরা কথায় কথায় মধ্যযুগীয় বর্বরতার ঢেকুর তুলি, আসলে আমরা কতটা তৃপ্তি নিয়ে সেটা দেই, নাকি আমাদের বর্তমানকালীন অন্ধকার আর অসভ্যতাকে আড়াল করতে অতীতকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করি?
যদি তুলনা করি, কি কি বৈশিষ্টের মানদন্ডে আমরা অপেক্ষাকৃত সভ্য , তবে বেশ খানিকট ভাবনার বিষয় আছে।
আদিম যুগের মানুষ কাঁচা মাংস খেত, উলংগ হয়ে বসবাস করত, শিক্ষাদীক্ষার নাম গন্ধও ছিলনা, রোগে শোকে ভুগে জীবন অতিবাহিত করত।
হ্যাঁ, এসব কথা যেমন সত্য, তেমনি সেই একই বৈশিষ্ট্য কি বর্তমান মানব সভ্যতায় উপস্থিত নেই? আমাদের নিজেদের কর্মকান্ড জীবনাচার আমাদের কাছে এখন শোভনীয় মনে হচ্ছে বলেই যে আমরা উত্তম এমন আত্বপ্রবঞ্চক ধারনা সত্যিই দু:খজনক।
আজকের যান্ত্রিক সভ্যতা কিংবা আরো সহজ কথায়, প্রযুক্তির যুগে আমদের কে একটি শ্রেষ্ট শ্রেষ্ট ভাব এনে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর অন্ধকার দিকটাও বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।
যুদ্ধ বিগ্রহ যে কোন যুগ বা সভ্যতার অন্ধকার দিক, আজকে আমরা যুদ্ধ নয় শান্তি চাই বলে যতই চিৎকার চেচামেচি করি না কেন, এই সভ্য জগৎও কিন্তু যুদ্ধের আদিম কিংব মধ্যযুগীয় ঐতিহ্য থেকে নিজেকে আড়াল রাখতে পারছে না, যুদ্ধে কে নায়ক আর কে খল নায়ক সেটি বিবেচনায় না আনলেও শুধু এটুকু চিন্তায় আনলেই যথেষ্ট যে, এই যে কোটি কোটি টাকার অস্র নির্মান, পারমানবিক অস্রের মজুদ সেটি কি এমনি এমনিই প্রদর্শনীর জন্য? একবার কি চিন্তায় আসে না, আমার আপনার পোশাক নিত্য নতুন জিজাইনের মতই নিত্য নতুন মারনাস্ত্রের প্রটোটাইপ তৈরি হচ্ছে এবং অস্রের বাজারে দাম হাকানো হচ্ছে।
কোন ভিন দেশী শত্রুর জন্য নয়, এগুলো এই পৃথিবীর মানব মানবীর হত্যার জন্যই তৈরী করা হয়েছে এবং হচ্ছে, তারপরো যদি আমরা দাবী করি আমরা সভ্যতার উৎকর্ষে, তবে উপহাস করেই বলতে হয়, গ্রো আপ ম্যান!
মানব সভ্যতাকে যদি পৃথিবীর একটি ক্ষুদ্র অংশের চাকচিক্য দিয়ে মান নির্ণয় করা হয় তবে সেটিও হবে মুর্খতা।
যাই হোক এসব বিষয় নিয়ে অনেক গবেষকই ভিবিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করে সভ্যতার উচ্চ কিংবা নিম্ন মান নির্ধারণ করার প্রয়াস পাচ্ছেন, গবেষণাও প্রচুর হচ্ছে, এই ক্ষুদ্র লেখায় সেগুলো নিয়ে লেখাকে দীর্ঘায়িত করতে চাচ্ছি না।
আমি একটি ব্যাপারে বেশ সচেতন, মানব জীবনের অপ্রত্যাশিয় মৃত্যুর হার নিয়ে।
আমাদের বর্তমান চোখে যে যুগ গুলো ব্যকডেটেড, কালো, সেই সব যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে, মানব জীবনের মুল্যহীনতা বা অনর্থক অপচয়, সেটি রোগে হোক কিংবা যুদ্ধে। কিন্তু আমরা কি অস্বীকার করতে পারি আজকের এই সভ্য জগৎ এর থেকে ব্যতিক্রম নয়? খাদ্য – বস্ত্রের অভাবে মৃত্যু কি অনুপস্থিত আজকের সভ্য পৃথিবীতে? মানব জীবন আজও কি মুল্যহীন নয় বর্তমান সভ্য জগতে?
বলা হয়ে থাকে রোগের মহামারীতে হাজার হাজার মানবের মৃত ছিল স্বাভাবিক, আজও কি সেটি সেই স্বাভাবিকতার উদাহরন নেই বর্তমান সভ্য জগতে? যে সভ্য জগতের বাসিন্দাদের অনেকেই জানে না ইবুলা কি কিংবা ইবুলা কি জিজ্ঞেস করলে বলে সেটি একটি পপ ব্যন্ড!
মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় বর্বরতায় হাজার হাজার মানবের মৃত্যুকে আজ অবিশ্বাস্য মনে হয়, কিন্ত সেদিন সেই সব মৃত্যুর জন্য প্রয়োজন ছিল যুদ্ধের, একটি প্রয়োজন সাপেক্ষ সময় সম্মুখ যুদ্ধ শেষে বিজয়ীরা হত্যা করত বিজিতদের, আজকের সভ্যতায় শত শত মৃত্যুর জন্য সম্মুখ যুদ্ধের প্রয়োজনও পড়ে না, অপেক্ষাকৃত অনেক কম সময়ে হাজার হাজার – শত শত মানব মৃত্যু সম্ভব এবং সেটির প্রমান আমরা পেয়েছি জাপানের হির্যোসিমা আর নাগাসাকিতে এবং সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে যে কোন সময়। একদিকে মানবতা মানবতা বলে কিছু খেকশেঁয়াল হুক্কা হূয়া দিয়েই যাচ্ছে অন্যদিকে তারই জ্ঞাতি ভাই নির্মাণ আর আবিষ্কার করে যাচ্চে নিত্য নতুন ধ্বংসাত্মক অস্র? আমি কি বিশ্বাস করব এসব অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে ভিন গ্রহের কারো সাথে বা এগুলো ব্যবহার করা হবে এলিয়েনদের সাথে যুদ্ধ করতে?
ভাবতে অবাক লাগে, নিজেদের চারপাশে পারমানবিক বোমার মজুদ রেখে আমরা পৃথিবী ও এর মধ্যে বসবাসকারী প্রানীদের জীবন বিপন্ন বলে বলে আক্ষেপ করি। বর্তমানে ভিবিন্ন দেশে যত সংখ্যক এই পারমানবিক বোম আছে এর সিকি ভাগও যদি ব্যবহার করা হয় তাহলে পৃথিবীতে মানুষ কেন কোন প্রানীরই অস্তিত্ব থাকবে না, আর সেই আমরাই, উন্নত মানব সভ্যাতার অধিকারী যারা কিনা মানুষের বসবাস উপযোগী পৃথিবী নিশ্চিত করতে পুর্বের যে কোন সভ্যতার মানুষের চেয়ে বেশি অগ্রগামী, কি হাস্যকর! রোগ শোকে মানুষের মৃত্যু আজ যতটানা প্রাকৃতিক, তার চেয়ে বেশি মানবীয়, বেঁচে থাকা কিংবা না থাকাটা নির্ধারন করছে অল্প কিছু এলিট, তাদের ল্যবরটরিতে নির্ভর করছে পৃথিবীতে কারা বেঁচে থাকবে আর কারা থাকবে না, এটিই বাস্তব সত্য, এটিই সভ্য জগতের আসল পরিচয়।
আজকের সভ্য জগতে শত শত মৃত্যুর আরেকটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে বিমান দুর্ঘটনা, এটি আরো ভয়াবহ। পলকেই কিংবা মিনেটের ব্যবধানে শত শত মানব জীবন ইতি টানে আমরা এই 2014 সালেই এর প্রমান পেয়েছি, ইউক্রেনের উপর দিয়ে যাওয়া MH370 এর বিমান যাত্রীদের মৃত্যু, মালেশিয়ান এয়াল্লাইসেন্সের MH17, 242 জন যাত্রীর নিখোঁজ, এবং এই কিছুদিন আগে এয়ার এশিয়ার 139 জন যাত্রীর মৃত্যু।
মৃত্যু তো মৃত্যুই, সে যুদ্ধেই হোক আর বিমান দুর্ঘটনাজনিতই হোক, মাধ্যম ভিন্ন হতে পারে কিন্তু ফলাফল তো সে একই, নিরপরাধ মানব জীবনের অপ্রত্যাশিত মৃত্যু।
আদিমযুগ কিংবা মধ্যযুগ, মানব জীবনের অপ্রত্যাশিত মৃত্যর মাধ্যম ছিল সীমাবদ্ধ, কিন্তু আজকের সভ্য জগতে অপ্রতাশিত মৃত্যুর মাধ্যম অনেক অনেক বেশি, সুতরাং আমাকে যদি বিশ্বাস করতে বলা হয়, আমি মানব সভ্যতার সবচেয়ে উন্নত যুগে বাস করছি, তবে আমাকে সেটি মেনে নিতে হবে যে, আজকের সভ্য জগত বৈচিত্র্য আর চাকচিক্যে হয়ত পুর্ববর্তী যুগের তুলনায় অনেক আপডেটেড কিন্ত মৌলিকতায় সমান, বরং বলা যায় অনেক নিম্নে।
তাই, আমি নিজেকে মানব ইতিহাসের সর্বোচ্চ সভ্য জগতের নাগরিক হিসেবে মানতে রাজি নই, নিজের যেটুকু পরিশীলিত জ্ঞান, বিবেক ও বুদ্ধি এখনো ধারণ করি, সেই বোধ থেকেই বলতে পারি, আমি এই তথাকথিত সভ্য জগতের বাসিন্দা হিসেবে গর্ববোধ করি না।
জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব